খাদ্যে ভেজাল : ইসলামী দৃষ্টিতে মহা অপরাধ

0
472
খাদ্যে ভেজাল

-ড. মোহা: এমরান হোসেন
খাদ্যে ভেজাল বলতে বুঝায়- অধিক মুনাফাখোরীর মনোভাব নিয়ে খাদ্যকে আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের রঙ মিশানো, খাদ্যকে আরো ঘণ করার জন্য এমাইলাম এর ব্যবহার, মধুতে কেইন সুগারের ব্যবহার, চাল ও মুড়িকে উজ্জ্বল এবং মাছ, মাংস ও সব্জির রক্ষণাবেক্ষণে এবং পশুকে মোটা তাজাকরণে ইউরিয়ার ব্যবহার, পচনরোধে ফল-মূল ও শাক-সব্জি এবং মাছ-মাংসে ফরমালিনের ব্যবহার, ফল পাকানোর কাজে কেলসিয়াম কার্বাইডের ব্যবহারকে বুঝায়। এ সমস্ত কেমিক্যাল অত্যন্ত বিষাক্ত। এগুলো মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এমনকি এগুলো ক্যান্সারের ন্যায় মরণব্যাধিকেও ডেকে আনতে পারে। বিধায় খাদ্যে ভেজাল একটি অনৈতিক ও অমানবীক কাজ। এগুলো মুমিনের তো নয়ই বরং মানুষেরই কাজ নয়। ইসলামে এ ধরনের কাজ চরমভাবে নিন্দিত। এতে কয়েক ধরনের অপরাধ জড়িয়ে আছে। এক. এটি প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি। দুই. এটি মূলত অবৈধ পন্থায় অপরের অর্থ গ্রহণ যা আত্মসাতের শামিল। তিন. ভেজালমিশ্রিত খাদ্য বিক্রয়ের সময় মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কসম করতে হয়। চার. মানুষকে কষ্ট দেয়া। পাঁচ. মানুষকে শারিরীকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা।
খাদ্যে ভেজাল দেয়া ক্রেতার সাথে প্রতারণা করা। প্রতারণা ইসলামে নিষিদ্ধ। হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা রাসূল (স.) বাজারে এক খাদ্যস্ত‚পের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্ত‚পের ভিতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভিতরেরগুলো ভিজা। তিনি খাদ্য বিক্রেতার নিকট জানতে চাইলেন- এটি কেমন কথা? সে বলল- বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, হে আল্লাহর রাসূল! তদুত্তরে রাসূল (স.) বললেন – তাহলে তুমি খাদ্যগুলো উপরে রাখনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত। অত:পর নবী (স.) বললেন- যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে সে আমার উম্মাত নয়। (সাহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১০২)।
খাদ্যে ভেজাল দেয়ার ফলে যে অতিরিক্ত অর্থ আসে তা অবৈধ পন্থায় উপার্জিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অবৈধ পন্থায় অপরের সম্পদ ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরাতুল বাকারার ১৮৮ নম্বর আয়াতে বলেন- “লা তাকূলু আমওয়ালাকুম বাইনাকুম বিল বাতিল” অর্থাৎ তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না। সম্পদ ভক্ষণের ক্ষেত্রে মূলত দুটি মূলনীতি আছে। এক. বস্তুটি স্বয়ং হালাল হতে হবে। যেমন মদ হালাল নয়। দুই. বস্তুটি হালাল হলেও তা উপার্জনের পন্থাটি বৈধ হতে হবে। যেমন আম একটি হালাল বস্তু। কিন্তু কেউ যদি তা চুরি করে সংগ্রহ করে তবে তা অবৈধ হবে। কেননা উহার উপার্জনের পন্থাটি বৈধ নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হালালবস্তুকে পবিত্র বলে এবং অবৈধ পন্থায় উপার্জিত বস্তুকে অপবিত্র বলে আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন।
যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরাতুল আ‘রাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে বলেন- “ওয়া ইউহিল্লু লাহুমুত তায়্যিবাতি ওয়া ইউহাররিমূ আলাইহিমুল খাবায়িছ” অর্থাৎ তাদের জন্য সকল পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে এবং সকল অপবিত্র বস্তু হারাম করা হয়েছে”। ভেজালযুক্ত খাদ্যের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ অবৈধ এবং হারাম।
যারা খাদ্যে ভেজাল দেয় তাদের উপার্জিত অর্থ অবৈধ হওয়ায় তাদের ইবাদত কবুল হবে না। কারণ মানুষের ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো হালাল রুজি। হারাম রুজির মাধ্যমে যে রক্ত-মাংস তৈরি হবে সে রক্ত-মাংসের শরীর দ্বারা কোনো ইবাদত কবুল হয় না। (মুসনাদু আবি ইয়ালা)। হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী (স.) বলেন- “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধূসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে দুহাত তুলে হে প্রভূ! বলে দোয়া করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মুনাজাত কিভাবে কবুল হতে পারে”! (সাহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১০১৫)। হযরত সাদ (রা.) রাসূল (স.) এর নিকট আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসূল (স.) বললেন- হে সাদ! তোমার উপার্জনকে হালাল রাখো, তোমার দোয়া কবুল হবে। মনে রেখো, কেউ যদি হারাম খাদ্যের এক লোকমাও মুখে নেয় তাহলে চল্লিশদিন যাবত তার দোয়া কবুল হবে না। (আল ইমাম আত তাবারানি, মুজামুল আওসাত)।
অপর এক হাদিসে আছে, “যে ব্যক্তি দশ দিরহাম দিয়ে কোন কাপড় ক্রয় করল এবং তার মধ্যে এক দিরহাম অসৎ উপায়ে অর্জিত সে যতোদিন ঐ কাপড় পরিহিত থাকবে ততোদিন তার নামায কবুল হবে না”। আল ইমাম ইবনুল ওয়ারদ বলেন- তুমি যদি জিহাদের ময়দানে যোদ্ধা হিসেবে অথবা প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত থাকো তবুও কোনো লাভ হবে না যতোক্ষণ না তুমি যা খাচ্ছো তা হালাল না হারাম তা বিবেচনায় রাখো।
আল ইমাম আবূ হানিফা (র.) একবার ব্যবসায়ের অংশীদার হাফস ইবন আবদির রহমান এর নিকট কিছু কাপড় পাঠালেন বিক্রয়ের জন্য। তারমধ্যে একটি কাপড়ে কিছু ত্রæটি ছিলো। আবূ হানিফা গ্রাহককে ত্রæটিটি দেখিয়ে দেয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু হাফস বিক্রয়ের সময় ত্রæটিটি উল্লেখ করতে ভুলে যান। এ কথা অবগত হয়ে আবূ হানিফা (র.) সমস্ত কাপড়ের বিক্রয়লব্ধ টাকা গরীব-দু:খীদের মাঝে বিতরণ করে দেন।
বৈধ পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা করা একটি মহৎ পেশা। এদের সম্পর্কে নাবী (স.) বলেন- সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীরা হাশরের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহিদদের সঙ্গে উত্থিত হবেন। (জামিউত তিরমিযি, হাদিস নম্বর-১২০৯)। কিন্তু যারা খাদ্যে ভেজাল দিবে তারা অসাধু ব্যবসায়ী। তারা মহাপাপী। তাদের সম্পর্কে নবী (স.) বলেন- নিশ্চয় কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদেরকে মহাপাপীরূপে উঠানো হবে। তবে যারা সততার সাথে ব্যবাসা পরিচালনা করেছে তারা ব্যতিরেকে। (জামিউত তিরমিযি, হাদিস নম্বর-১২১০)।
খাদ্যে ভেজালদানকারী মূলত অপরের মাল আত্মসাতকারী এবং বান্দার হক নষ্টকারী। বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে ক্ষমা করবে। একদা নবী (স.) তাঁর পাশে উপবিষ্ট সাহাবিদেরকে বললেন- তোমরা কি জান, গরীব কে? সাহাবিরা বললেন – আমাদের মধ্যে তো গরীব তাদেরকে বলা হয়, যাদের কাছে ধন-সম্পদ, টাকা পয়সা না থাকে। তখন নবী (স.) বললেন- প্রকৃতপক্ষে আমার উম্মাতের মধ্যে সবচেয়ে গরীব সে, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোজা, যাকাত সবকিছু নিয়ে উঠবে, কিন্তু তার এ কর্মগুলো থাকবে যে, সে দুনিয়াতে কারো সাথে মন্দ আচরণ করেছে, কারো নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাত করেছে, কাউকে আঘাত করেছে, কাউকে খুন করেছে ইত্যাদি। সেদিন তার সৎকাজ দিয়ে অর্জিত নেকীগুলো দিয়েই হকদারদের হক পরিশোধ করা হবে। যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায় তাহলে এই হকদারদের গুনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সাহিহ মুসলিম)। অতএব যারা খাদ্যে ভেজাল দেয়ার মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করবে তাদের নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান-সাদকাহ কোনো কাজে আসবে না।
খাদ্যে ভেজাল দেয়ার অর্থ হলো সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ। আল্লাহ বলেন- তোমরা সত্যের সাথে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না। (সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত নম্বর- ৪২)। রাসূল (স.)কে জিজ্ঞেস করা হলো, একজন মুমিন দুর্বল হওয়া কি স্বাভাবিক? তিনি বললেন- হ্যাঁ, হতে পারে। আবারও জিজ্ঞেস করা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? তিনি বললেন- হ্যাঁ। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, একজন মুমিন কি মিথ্যুক হতে পারে? তিনি বললেন- না। (সুনানুল বায়হাকি, হাদিস নম্বর-৪৮১২)।
এছাড়াও যারা খাদ্যে ভেজাল দেয় তারা অনেক সময় মিথ্যা কসম করে বলে- আল্লাহর কসম, এটি খাঁটি মাল। এভাবে মিথ্যা কসম করে পণ্য বিক্রয়কারী সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কোনো কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো, যে তার ব্যবসায়িক পণ্য মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রয় করে। (সাহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর-১০৬)।
অপরের হক নষ্টকারী সম্পর্কে আবূ উমামাহ (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে নবী (স.) বলেন- যে ব্যক্তি তার নিজ হাতে কোনো মুসলিমের হক খেয়ে ফেলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেন এবং জান্নাত হারাম করে দেন। একজন লোক প্রশ্ন করলো, যদি তা সামান্য বস্তু হয়? তখন তিনি (স.) বললেন- দেখতে যদি তা আরাক গাছের ডাল পরিমাণও হয় তথাপিও। (সাহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর- ৩৭০)।
ভেজালযুক্ত খাবার ক্রয় করে ক্রেতা অনেক কষ্ট পায়। মুসলমানকে শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া কষ্ট দেয়া হারাম। এতে মানুষ প্রকৃত মুসলমান থাকে না। সে হয় বড় ক্ষতিগ্রস্থ মিথ্যা পাপের বোঝাবহনকারী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরাতুল আহযাবের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলেন- যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয় তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করবে।
খাদ্যে ভেজাল শুধুমাত্র মানুষের মানসিক ও আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা মানুষের জীবনও নষ্ট করে দেয়। ফরমালিন, কারবাইড ইত্যাকার বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত খাবার খেয়ে বিভিন্ন জটিল অসুখে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। গরীবরা টাকার অভাবে সুচিকিৎসা না করতে পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলেও পড়তে পারে। কাজেই যারা খাদ্যে ভেজাল দেয় তারা মানুষের জান ও মালের ক্ষতিকারক। যারা জান ও মালের ক্ষতি করে তারা প্রকৃত মুমিন হতে পারে না। জামিউত তিরমিযী ও সুনানুন নাসায়ীতে হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে নবী (স.) বলেন- মুসলমান তাকে বলা হবে যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ এবং মুমিন ঐ ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে অন্য মানুষের জান ও মালের কোনো শঙ্কা না থাকে।
শুধুমাত্র আইন করে বা শাস্তির ব্যবস্থা করে খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার মানুষের নৈতিকতাবোধ এবং পরকালীন জবাবদিহিতার বোধ জাগ্রত করা। একজন সত্যিকারের মুমিন, একজন সত্যিকারের পরকালবিশ্বাসী মানুষ খাদ্যে ভেজাল মিশাতে পারে না, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য খাইয়ে মানুষকে অসুস্থ করতে পারে না। হযরত উমার (রা.) এর শাসনামলের একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য খলিফা উমার রাতের আঁধারে ছদ্মবেশে বের হয়েছেন। পথিমধ্যে একঘর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলেন- মা মেয়েকে বারবার দুধে পানি মিশাতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি বলছে- খলিফা দুধে পানি মিশানো বেআইনী ঘোষণা করে ফরমান জারি করেছেন। মা বলল, খলিফা এতো রাতে তো এসে দেখছে না। একথা শুনে মেয়েটি বলল- খলিফা না দেখতে পারেন, আল্লাহ তো দেখছেন। এ মেয়েটির কাছ থেকে তাকওয়ার এ চমৎকার শিক্ষা নিলে আমরাও পেতে পারি স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য।

আরও পড়ুনঃ   হস্তমৈথুন থেকে মুক্তি লাভের উপায় : শেষ পর্ব

খাদ্যে ও ঔষধে ভেজাল
-লেখক : অধ্যক্ষ, শংকরবাটী হেফজুল উলুম, এফ. কে. কামিল মাদরাসা

স্বাস্থ্য বিষয়ক আরও টিপস ,সংবাদ ও তথ্যের জন্য নিয়মিত ভিজিট করুন –BD Health

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

6 + 8 =