আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিষয় সম্পৃক্ত এরকম একটা সংগঠনের উদ্যোগ কেন নিলেন?
– আসলে বাংলাদেশে এরকম কোনো অর্গানাইজেশন নেই। আমি নিজেই এটার খোঁজ করেছিলাম যখন আমার বাচ্চাদের মধ্যে হতাশা দেখেছিলাম। কিন্তু সেই সময়টা ওরা আমাকে দেয়নি। ওদের কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগেই, চিকিৎসা করার আগেই ঘটনাটা ঘটে যায়। একটা ব্যাপার যেটা আমার মধ্যে ভেতরে কাজ করেছে যে এই জিনিসটা আমি সহজে পাইনি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চট একটা উপদেশ নেব, বা বাচ্চাদেরকে দেখাব-সায়ক্রিয়াটিক ট্রিটমেন্টটা বাংলাদেশে ভারী সহজলভ্য নয়। আর আমার মনে হয়েছে যে সুইসাইড কেন- মানুষের বাচ্চা অসুস্থ হয়ে মারা যায় সেটা মানা যায়, অসুস্থ হয়ে মারা যায় সেটাও মানা যায় কিন্তু সুইসাইডের যে দুঃখ সেটা অযাচিত দুঃখ। সুইসাইডটা কোনো সমাধান না। যাই হোক এটা আমাকে করতেই হবে এরকম মনে হয়েছে। বিদেশে এরকম অনেক সংগঠন আছে, কিন্তু বাংলাদেশে নেই। এমনকি ভারত, পাকিস্তান শ্রীলঙ্কায়ও আছে। বাংলাদেশে এ বিষয়ে সচেতনতা একেবারে জিরো। সে কারণে আমি শুরু করি।
কবে থেকে সংগঠনটি শুরু করেন?
– এ বছরেরই মে মাসের আটাশ তারিখ থেকে সংগঠনের কাজ শুরু হয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে আমার বাচ্চারা চলে যায়। ১৫ ই সেপ্টেম্বর। আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের মাত্র পাঁচদিন পরে।
আপনার সংগঠনের নাম ‘ব্রাইটার টুমরো’। এই নামকরণের কি কোনো বিশেষ কারণ আছে ?
– আসলে প্রথমে আমি নামটা দিয়েছিলাম ‘Tear Drops of a Mother’. কিন্তু পরে মনে হলো এই নামটা উদ্দীপনা জোগায় না। পরে মাইকেল জ্যাকসনের ‘Heal the World’ গানটা থেকে ‘Brighter Tomorrow’ কথাটা আমি নিই। এই গানটা আমার অনুপ্রেরণা। আমার এই উদ্যোগ নেয়ার পেছনে গানটার একটা ভূমিকা আছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রাইটার টুমরোর কার্যক্রম কী ছিল?
– আসলে আমরা একেবারে শুরুর পর্যায়ে আছি। আমরা একটা অনুষ্ঠান করেছি। সফল হয়েছে অনুষ্ঠান। ভালো সাড়া পাওয়া গিয়েছে।
আপনারা কীভাবে অগ্রসর হতে চান বা আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
– যেহেতু সচেতনতা নেই। তাই সচেতনতা তৈরি করা আমাদের কাজ। সুইসাইড প্রতিরোধের জন্য আসলে সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। এটা তো খাদ্য দেয়ার মত না, যে একজনের ক্ষুধা লেগেছে আমি তাকে খাবার দিলাম। এটা আসলে মানসিক পর্যায়ের ব্যাপার। কাউকে কাউকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আবার কারো কারো আছে কেমিক্যাল ডিসঅর্ডার, তাদেরকে কথা দিয়ে ফেরানো সম্ভব নয়। আমাদের সংগঠনের কাজ হচ্ছে যেকোনো ভাবে এদেরকে ফেরানো। ফেরানোর জন্য যা যা কিছু করতে হয় তাই আমরা করবো।
আপনারা কি এই কার্যক্রমগুলো শুরু করেছেন?
-আমরা তো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। এগুলো আমাদের পরিকল্পনায় আছে- স্কুলে আমরা জরিপ চালাবো। আমাদের নিজস্ব কাউন্সিলর থাকবে। আমরা গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।
তরুণদের মধ্যে তো এই প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি। আত্মহত্যার মত বিধ্বংসী পথ বেছে নিতে আমাদের সমাজও কি প্রভাবিত করে ?
– হ্যাঁ তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর সমাজের ভূমিকা আছে অবশ্যই। সেটা নিয়েও আমরা কথা বলবো। ধরো, এই যে ইভ টিজিং, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়- শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি তারপর পারিবারিক সংকট এগুলো নিয়ে আমরা কথা বলবো। আমরা চেষ্টা করবো এগুলো যেন চলে যায়।
আমাদের বর্তমান জীবন প্রণালির প্রচণ্ড ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা কি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে?
– হ্যাঁ সেটা তো রাখেই। এই যে বাচ্চারা একা একা থাকে আমরা সময় দিতে পারি না। আমাদেরকে তাদের মানসিকতাটা বুঝতে হবে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধের মত বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারেরও নিশ্চই ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
– সাংগঠনিক কাজ বা উদ্যোগগুলো আমরা নিজেরা করতে পারবো। কিন্তু সচেতনতা তৈরির কাজটি বিস্তৃত পরিসরে করতে অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা হেল্প লাইন চালু করলে কয়টা করতে পারবো? কিন্তু সারাদেশে সব টেলিফোনে যদি একটা করে হেল্পলাইন চালু হয় সেটা অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। আর এখনো বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হয় না। এটা শুধু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একটা দিবস। আমরা সরকারকে অনুরোধ করবো দিবসটি পালন করতে। আমাদের উদ্যোগের সর্বোচ্চ সফলতার জন্যও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে।
সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা কীভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পারি?
– এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো- ফেসবুক, টুইটার। এগুলোর মাধ্যমে দাবী জানানো, স্ট্যাটাস দেয়া, বন্ধু-বান্ধবদের ট্যাগ করে দেয়া। কারণ এখন কিন্তু লিফলেটের চেয়ে এগুলো চলে বেশি। যুগটাকে বুঝতে হবে। এরপর যেগুলো জিনিস আমাদের দেশে চর্চা হয় না, যেমন- সিনেমা হলে সিনেমা শুরুর আগে একটা ডকুমেন্টারি দেখানো হলো বা রেডিও-টেলিভিশনে এরকম একটা বিশেষ দিবস কে সামনে রেখে বুলেটিন প্রচার করা হলো- এগুলো করা যেতে পারে। পত্র-পত্রিকায়ও লেখা যেতে পারে। সুইসাইডের নিউজ আর সুইসাইড প্রতিরোধের নিউজ কিন্তু এক কথা না। সুইসাইডের নিউজ কখনো প্রথম পাতায় জায়গা পাবে না। কিন্তু প্রতিরোধটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ওটা ব্যাপক আকারেই লিখতে হবে। ‘আত্মহত্যা’ শব্দটা না ব্যবহার করে আমরা লিখতে পারি ‘মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা’। কিন্তু আমাদের ভেতরের কথাটা থাকবে আত্মহত্যা প্রতিরোধ। ‘আত্মহ্ত্যা’ শব্দটাকে অত বেশি ব্যবহার না করা ভালো। এভাবে বুঝেশুনে আমাদের কাজ করতে হবে। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য- আত্মহত্যা প্রতিরোধ। যেটা এবারের আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসেরও প্রতিপাদ্য- Preventing Suicide: Reaching Out and Saving Lives. বা আত্মহত্যা প্রতিরোধের উদ্যোগ নিন: জীবন বাঁচান। এটা আমাদেরও প্রতিপাদ্য।
জয়শ্রী জামানের মত আমরাও প্রত্যেকটা মানুষের কাছে জীবনের মহিমাকে পৌঁছে দিতে চাই, বলতে চাই- আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ নয়, জয় হোক জীবনের। মাইকেল জ্যাকসনের যে গানটা সন্তান হারানো মায়ের মনে প্রবোধ জুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, মানুষকে জীবনে ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে নামার সেই গানটার উপলব্ধি বিস্তৃত হোক প্রতিটা মানুষের মনে-
“There are people Dying
If you Care Enough
For The Living
Make A Better Place
For You And For Me”
সাদিকা রুমন
বিশেষ প্রতিবেদক, মনেরখবর