তিন ফলের সমাহার ত্রিফলা। আমলকী-বিভীতকী-হরীতকী—তিন ফলের মধ্যে রয়েছে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। তিনটি ফলের আলাদা আলাদা উপকারিতা রয়েছে। কিন্তু যখন এই তিন ফলের গুণ একসঙ্গে পাওয়ার আশা করা হয়, তখন তা একত্র হয়ে বহুবিধ গুণে রূপান্তরিত হয়। প্রবাদ আছে, এই তিন ফল পানিতে ভিজিয়ে রেখে প্রতিদিন সকালে ওই পানি এককাপ পরিমাণ পান করলে মানুষের সব রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে এবং রোগ নিরাময় করে।
আমলকী: বাংলাদেশের অবহেলিত মূল্যবান তরু আমলকী। শুধু ভেষজ গুণে নয়, সৌন্দর্যেও সে সমাদরযোগ্য। প্রচলিত ফলের মধ্যে আমলকীতে ভিটামিন সি সবচেয়ে বেশি। এটি ছোট বা মাঝারি আকারের পাতাঝরা বৃক্ষ। এ গাছ ১০-২০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছের বাকল স্তরবিশিষ্ট। আমলকীর বৈজ্ঞানিক নাম Phyllanthus emblica officinalis। বৈজ্ঞানিক নামের প্রথমাংশ ফাইল্যান্থাস কচি পাতার কোমল সবুজের উচ্ছলতার প্রতীক (গ্রিক) ও ভেষজ গুণের রূপক এবং এম্বলিকা নামাংশ ভারতীয় আমলকীর লাতিন রূপায়ণ। শীতকালে আমলকীর পাতা ঝরে যায়। বিশ্বকবি লিখেছেন, ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন,/ আমলকীর এই ডালে ডালে।/ পাতাগুলি শিরিশরিয়ে/ ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’
আমলকীর জন্মস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। পাহাড়ের প্রায় এক হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতায়ও এ গাছ জন্মে থাকে। পাতা পক্ষল ও যৌগিক। বোঁটার দুই পাশে চিরুনির দাঁতের মতো সাজানো থাকে। আমলকী ফুল একলৈঙ্গিক। পুরুষ ফুল বোঁটাযুক্ত। এ ফুল ডালের ওপরের দিকে ধরে, আগে আসে এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। স্ত্রী ফুল বোঁটাহীন ও ডালের নিচের দিকে ধরে। ফুল আকারে খুবই ছোট, খালি চোখে দেখা কষ্টসাধ্য। স্ত্রী ও পুরুষ ফুল একই শাখায় প্রস্ফুটিত হয়। আমলকী বায়ুপরাগায়িত। এপ্রিল-মে মাসে ফুল ধরে। ফল মৃদু শিরাবিশিষ্ট, গোলাকৃতি, মাংসল ও রসাল। ফলের রং হালকা সবুজ বা হলুদ। ভেতরে ছয়টি বীজের সমষ্টির একটি কঠিন আঁটি থাকে। এ উপমহাদেশে আমলকীর বেনারসি জাতটি সবচেয়ে ভালো। ফল পাকে শীতকালে। ফলের প্রতি ১০০ গ্রামে ৮১ গ্রাম পানি, ০.৫ গ্রাম আমিষ, ১৪ গ্রাম শ্বেতসার, ০.১ গ্রাম স্নেহ, ০.৭ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ৩.৫ গ্রাম আঁশ, ০.০৫ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.০২ গ্রাম ফসফরাস, ১.৫ গ্রাম আয়রন, ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি এবং ১৪০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে। প্রতি ১০০ গ্রামে ৫৯ কিলোক্যালরি তাপশক্তি বিদ্যমান।
আমলকী প্রক্রিয়াজাত করলে ভিটামিন সি-এর পরিমাণ কমে যায়, তবে আমলকীর অ্যাসকরবিক এসিড স্থায়ী। কেননা, এটা ট্যানিন ও অ্যান্থোসায়ানিন দিয়ে আবৃত থাকায় সহজে অক্সিডেশন হয় না। নিষ্কাশিত ফলের রসের ভিটামিন এক সপ্তাহ পর্যন্ত অবিকৃত থাকে। একটু সচেতন হলে প্রতিটি বাড়িতে একটি আমলকীগাছ রোপণ করলে ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য ভিটামিন সি-এর ভালো উৎস আমরা রেখে যেতে পারি। কাঁচা আমলকী খাওয়া হয়। আমলকীর জেলি, মোরব্বা বেশ সুস্বাদু। ফল ফালি করে কেটে রোদে শুকিয়ে লবণ, জোয়ান ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে মুখশুদ্ধি হিসেবে ব্যবহার হয়। আমলকীর ভেষজ গুণ অনেক। আমলকীর রস যকৃত, পেটের পীড়া, অজীর্ণ, হজমি ও কাশিতে বিশেষ উপকারী। আমলকীর পাতার রস আমাশয়ের প্রতিষেধক, এর বাকল থেকে রঞ্জক তৈরি হয়। এর কাঠ রক্তবর্ণ, দৃঢ়। এটির কাঠ কৃষির যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহার হয়। শুকনা ফল শ্যাম্পু, কলপ ও কালির উপাদান। শুকনা আমলকী তেলের সঙ্গে মিশিয়ে মাথায় মাখলে অল্প বয়সে চুল পাকা প্রতিরোধ হয়। শুকনো ফল থেকে Phyllenblin(ethyl gallate) পৃথক করা যায়, তা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের হতাশায় কাজ করে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিশোধিত গাছের extract lowdensity lipid কমায়। বীজ, শাখা কলম এবং জোড় কলম থেকে আমলকীর বংশবিস্তার করা যায়। প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে ২০০ কেজি ফল পাওয়া যায়।
আমলকী, বিভীতকী (বহেড়া), হরীতকী এই তিন ফল ভিজিয়ে প্রতি সকালে ওই পানি পান করলে সুস্থ দেহে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়।
বিভীতকী (বহেড়া): বৃহদাকার পাতাঝরা বৃক্ষ বিভীতকীর। উচ্চতা ১৫-২৫ ফুট। বিভীতকী বহেড়া নামে বেশি পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia belerica.
কথিত আছে, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দেবরাজ ইন্দ্র অমৃতের সন্ধানে যখন সমুদ্র মন্থন করছিলেন, সে সময় এক ফোঁটা অমৃত মর্ত্যে পড়ে এই বহেড়াগাছের জন্ম।
এই গাছের জন্মস্থান ভারতে। সংস্কৃতে ‘বিভীতকী’ শব্দের অর্থ, এমন জিনিস, যা সব রোগ থেকে দূরে রাখে। বাংলাদেশের বনাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এ গাছ দেখা যায়।
বাকল ধূসর ছাই রঙের। বাকলে লম্বা ফাটল থাকে। পাতা গাছের ডালের আগায়। আকৃতি কাঁঠালের পাতার মতো। বোঁটা লম্বা। পাতা লম্বায় প্রায় পাঁচ ইঞ্চি। ফুল হয় পাতার বোঁটার বাহুমূল থেকে। ফুল ডিম্বাকৃতি, প্রায় এক ইঞ্চির মতো লম্বা। রং সবুজাভ-হলুদ। ফোটে অক্টোবরের দিকে।
ফল প্রায় ডিম্বাকৃতি, কিন্তু ওপর প্রান্ত তীক্ষ। ব্যাস প্রায় এক ইঞ্চি। রং গাঢ় বাদামি। ফল পাকে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ফলের বাইরের আবরণ মসৃণ ও শক্ত। ভেতরে একটিমাত্র শক্ত বীজ থাকে।
বহেড়া ফল এই উপমহাদেশে প্রাচীনতম আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। কথিত আছে, প্রতিদিন বহেড়া ভেজানো পানি এক কাপ পরিমাণ পান করলে দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। বহেড়া নিয়ে বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে ও এখনো হচ্ছে।
বহেড়ায় আছে ট্রাইটারপেনয়েডস, কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড, সিটোস্টেরল, ট্যানিন, গেলোইল গ্লুকোজ, পামিটিক এসিড ও লিপোলিক এসিড।
বহেড়া বিশেষভাবে পরিশোধিত করে এর ফল, বীজ এবং বাকল ব্যবহূত হয় মানুষের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ও চিকিৎসায়।
বহেড়া হূৎপিণ্ড এবং যকৃতের রোগের আক্রমণ কমায়। সর্দিকাশি, পাইলস, কৃমিনাশক, জ্বরনাশক, অনিদ্রা, হাঁপানি, কুষ্ঠ এসব রোগের চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়।
বহেড়ার কাঠ হরিদ্রাভ ও শক্ত। কাঠ পানিতে সহজে পচে না, নৌকা তৈরিতে ব্যবহার হয়। ফল থেকে লেখার কালি বানানো হয়। বীজ থেকে বিশেষভাবে অঙ্কুরোদ্গম করা হয়। বহু বছর বাঁচতে পারে বহেড়া গাছ।
হরীতকী
হরীতকী মধ্যম থেকে বৃহদাকারের পাতাঝরা বৃক্ষ। আমাদের দেশের বনাঞ্চলে বা গ্রামাঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে এ গাছ দেখা যায়। উচ্চতা ৪০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পাতা ঝরে নতুন পাতা গজাতে থাকে।
হরীতকীর বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia chebula. বাংলাদেশ ও ভারতে এর আদি নিবাস। বাকল গাঢ় বাদামি। বাকলে লম্বা ফাটল থাকে। পাতা লম্বা-চ্যাপ্টা, কিনার চোখা, লম্বায় পাঁচ-ছয় ইঞ্চি।
ফুল ফোটে ডালের শেষ প্রান্তে। রং হালকা হলুদাভ সাদা। ফল লম্বাটে, মোচাকৃতি। লম্বায় প্রায় দেড় ইঞ্চি। কাঁচা ফল সবুজ, পরিপক্ব ফল হালকা হলুদ। শুকালে কালচে খয়েরি রং হয়। ফলের ত্বক ভীষণ শক্ত। এই ফল বছরের পর বছর ভালো থাকে। ফলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা লম্বা পাঁচ-ছয়টি শিরা থাকে। ফলের বাইরের আবরণ কুঁচকানো। ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা হয়। ফলের ভেতর একটিমাত্র ভীষণ শক্ত বীজ থাকে।
হরীতকীর কাঠ খুব মজবুত। এই কাঠ ফ্রেম, খুঁটি, আসবাব তৈরিতে ব্যবহূত হয়। বীজ থেকে চারা তৈরি করা যায়।
প্রচলিত আছে, প্রতি সকালে এক কাপ পরিমাণ হরীতকী ভেজানো পানি ব্যবহার করলে রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। আমলকী ও বিভীতকীর (বহেড়া) সঙ্গে হরীতকী ভেজানো পানি, সব রোগের আশ্চর্য মহৌষধ।
হরীতকী চূর্ণ ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে, পিত্তশূল দূর হয়। পাইলস, হাঁপানি, চর্ম রোগ, ক্ষত রোগ, কনজাংটিভাইটিস রোগে হরীতকী ব্যবহূত হয় বিশেষভাবে পরিশোধনের মাধ্যমে।
নড়াইল জেলার লোহাগড়ায় নবগঙ্গা নদীর ধারে বিখ্যাত লক্ষ্মীপাশা কালীবাড়ির প্রাঙ্গণে একটি বিশালাকার হরীতকীর গাছ আছে। বহু বছর বাঁচতে পারে এ গাছ।
কান্তা রিমি রায়
সহযোগী অধ্যাপক, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ
bkbosebd¦yahoo.co.in