ইসলামে মানব জীবনের সামগ্রিক দিক পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথভাবে আলোচিত হয়েছে। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কেও ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা সম্পর্কেও ইসলামে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। ইসলাম প্রথমত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সতর্কতা সত্ত্বেও কোনো রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয়ে গেলে এর সুচিকিত্সা নিশ্চিত করার প্রতিও রয়েছে জোরালো তাগিদ।
কোরআন-সুন্নাহর আলোকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। সবলতা ও সুস্থতাই ইসলামে কাম্য। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের সত্তা শক্তির আধার। তাঁর শক্তি অসীম ও অতুলনীয়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান প্রভুর নিপুণ সৃষ্টিরাজিতেও শক্তির সঞ্চার করেছেন। তাঁর ওহির বাহক হজরত জিব্রাইল (আ.) এর শক্তির প্রশংসা তিনি নিজেই করেছেন। যে নবীর ওপর তাঁর পবিত্র কালাম অবতীর্ণ হয়েছে, তাঁকেও দান করেছিলেন বিশাল শক্তি। একশ’ পুরুষের যে শক্তি, এককভাবে আল্লাহতায়ালা তাঁর নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তা দান করেছিলেন। এর দ্বারা আল্লাহ কাছে তাঁর অন্যতম গুণ শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ জন্য রাসুল (সা.) হাদিসে এরশাদ করেছেন, ‘যে ঈমানদার ব্যক্তির শারীরিক শক্তি আছে, তিনি শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর নিকট প্রিয় সে মুমিন অপেক্ষায় যে দুর্বল, শক্তিহীন, যার শারীরিক শক্তি কম।’ কারণ ইবাদত করার জন্য শারীরিক শক্তি প্রয়োজন। তার পথে সংগ্রাম করার জন্য শক্তি প্রয়োজন। শারীরিক শক্তি আল্লাহতায়ালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। হাদিস শরীফে রাসুল (সা.) পাঁচটি অমূল্য সম্পদ হারানোর আগে এগুলোর মূল্যায়ন করার কথা বলেছেন। এর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা। যথাযথ বিশ্রাম না নিলে মানবদেহ স্বভাবতই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বার্ধক্য আসার আগেই বার্ধক্যের কোলে ঢলে পড়তে হয় এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে পতিত হতে হয়। কারণ মানবদেহ একটি ইঞ্জিন বা যন্ত্রের মতো। একটানা কোনো ইঞ্জিন চলতে থাকলে সেটা যেমন খুব দ্রুত অকার্যকর হয়ে পড়ে, তেমনি মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না হলেও তা দ্রুত অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। এক সাহাবি দিনভর রোজা রাখতেন আর রাতভর নামাজ পড়তেন। রাসুল (সা.) তাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয় তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে।’ স্বাস্থ্য রক্ষা করা শরিয়তের তাগিদ। এটাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। শরয়ী আইনের অন্যতম টার্গেট হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা। কোরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামী শরিয়ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যেমন গুরুত্ব দিয়েছে, তেমনি তা কার্যকরের ফলপ্রসূ উপায় বলে দিয়েছে। যেমন নেশাজাতীয় দ্রব্য হারাম করা, পরিমিত আহার, সময়ানুগ খাবার গ্রহণ ইত্যাদি। কাজেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সচেষ্ট হওয়া ঈমান ও বিশ্বাসের দাবি।
স্বাস্থ্য রক্ষার পরপরই ইসলাম রোগ প্রতিরোধের প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছে। রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করতে উত্সাহিত করেছে। আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানের স্লোগান হচ্ছে চত্বাবহংরড়হ রং নবঃঃবত্ ঃযধহ পঁত্ব (চিকিত্সার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ উত্তম)। আমরা দেখতে পাই যে জিনিসগুলোর কারণে মানুষের রোগ জন্ম নেয়, ইসলাম আগেই সেগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। হাদিসের প্রায় সব কিতাবেই একটি অধ্যায় আছে ‘কিতাবুত তিব’ বা চিকিত্সা অধ্যায়। সেগুলোতে চিকিত্সা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আলোচিত হয়েছে।
মানুষের রোগ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মানুষের অলসতা ও কর্মবিমুখতা। রাসুল (সা.) দোয়া করেছেন ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অলসতা হতে পানাহ চাই।’ উচ্চ রক্তচাপ, ব্লাড প্রেসার, ডায়বেটিস, শ্বাসজনিত প্রদাহ—এসব রোগের প্রধান উত্স মূলত আলস্য ও কর্মবিমুখতা। অতি ভোজনও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পেটকে সব রোগের কেন্দ্রস্থল হিসেবে হাদিসে আখ্যা দেয়া হয়েছে। ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, যখন ক্ষুধা পাবে কেবল তখনই খাবে। কোরআন মজিদে এরশাদ হচ্ছে ‘খাও, পান করো কিন্তু অতিরিক্ত করো না।’ হাদিসে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা উদরপূর্তি করে ভোজন করো না, কেননা তাতে তোমাদের অন্তরে আল্লাহ পাকের আলো নিষপ্রভ হয়ে যাবে।’ একথা সর্বস্বীকৃত যে, দেহের ক্ষয় পূরণের জন্য ও তার উন্নতির জন্যই আমরা আহার করে থাকি। তবে এ আহার করারও একটি স্বাস্থ্যসম্মত নীতি রয়েছে। যে নীতিমালা লঙ্ঘিত হলে সে আহারই শরীরের ক্ষয় পূরণের পরিবর্তে তাতে বরং ঘাটতি এনে দেবে। শরীরে জন্ম নেবে নানা রোগের উপকরণ। মহানবী (সা.) এর সবক’টি সুন্নাতই বিজ্ঞানভিত্তিক ও স্বাস্থ্যসম্মত। কেউ যদি ঘুম থেকে জাগা, পানাহার, চাল-চলন, মলমূত্র ত্যাগসহ যাবতীয় কার্যাবলি সুন্নাত অনুযায়ী সম্পাদন করেন, তাহলে জটিল রোগের ঝুঁকি থেকে তিনি মুক্ত থাকতে পারবেন। যেমন—মাটির ঢিলা ব্যবহার, হাঁচি ও হাই তোলার সময় নাক ঢেকে রাখা, মেসওয়াক করা, রাগ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খুবই সহায়ক। তাছাড়া রোগ-ব্যাধি ছড়ানোর বড় কারণ হচ্ছে অপরিষ্কার ও নোংরা পরিবেশ। পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের প্রতি ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এমন কোনো কাজই ইসলামে স্বীকৃত নয়। এ জন্য ইসলামসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়া সহজতর হয়। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার পরও যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে তার করণীয়ও ইসলাম নির্দেশ করেছে। একজন মুসলিম নিজে বা তার পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে প্রথমে সে আল্লাহর রহমত প্রত্যাশা করবে। আল্লাহ রোগ দিয়েছেন তিনিই সুস্থতা দান করবেন—এ বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে হবে। তবে আল্লাহর ওপর ভরসার পাশাপাশি ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করাও ইসলামের শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিত্সা করো। কারণ যিনি রোগ দিয়েছেন তিনি তাঁর প্রতিকারের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’ এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে প্রশ্ন করেন যে হে আল্লাহর রাসুল! আমরা রোগ হলে চিকিত্সা করি, তা কি তাকদির পরিপন্থী নয়? উত্তরে তিনি বললেন—না, চিকিত্সা গ্রহণ করাই হলো তাকদির। রাসুল (সা.) রোগের প্রতিষেধক হিসেবে মধুর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। গবেষণা করে দেখা গেছে, একমাত্র মধুর ব্যবহারেই হাজারো রকমের কঠিন ও জটিল রোগ থেকে অতি অল্প সময়েই আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। মানবদেহের সুস্থতার জন্য যত প্রকার ভিটামিন আবশ্যক, তার ৭৫ ভাগই মধুর মধ্যে বিদ্যমান। চিকিত্সাশাস্ত্রের মতে, মধু অপেক্ষা শক্তিশালী ভিটামিনযুক্ত পদার্থ পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি।
স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ। ইসলামের এই নির্দেশনা মতো চললে ইহ ও পারলৌকিক সফলতা অবশ্যম্ভাবী। ইসলাম যে স্বাস্থ্য নির্দেশনা দিয়েছে তা পালন করলে একজন মুসলমান অনেক জটিল রোগ-ব্যাধি থেকে বেঁচে যেতে পারে।
মামুন মল্লিক