যক্ষ্মা হলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই

0
444
যক্ষ্মা ,tuberculosis awareness

‘‘যার হয় যক্ষা তার নাই রক্ষা’’ এক সময়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল এই আপ্তবাক্যটি। যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তি ছিল সমাজে অস্পৃশ্য। রোগের জটিলতা ও সামাজিক অবহেলা এ দুইয়ের ভয়াবহতায় রোগাক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করতো। যার কারণে এমন প্রবাদের উৎপত্তি।
সে সময়কালে যক্ষ্মা বা টিবি ছিল একটি ভয়াবহ সংক্রমক ব্যাধি। সুনির্দিষ্ট কারণ জানা ছিল না বলে এর সুচিকিৎসার কোন উপায় ছিল না। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় এ রোগের জীবাণু আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে, উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিকতর থেকে আধুনিকতম চিকিৎসা ব্যবস্থা। থেমে নেই মানব কল্যাণে নিয়োজিত বিজ্ঞানীরা। প্রতিনিয়ত বদলে দেয়ার চেষ্ঠা চলছে এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার দিগন্ত। এক সময়কার এই জটিল সংক্রমক ব্যাধিটি এখন আর আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। তারপরেও আমদের অজ্ঞতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে যক্ষ্মা রোগের কিছু জটিল প্রকারের উদ্ভব হচ্ছে যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বতো বটেই উন্নত দেশগুলোর জন্যও ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। তাই বর্তমানে যক্ষ্মা রোগের সঠিক ও নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চিকিৎসা শুধুই নয় এর সংক্রমণ প্রতিরোধে সুব্যবস্থাপনার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
মাইকোব্যাকক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক জীবানুটি যক্ষা বা টিবি রোগের জন্য দায়ী। যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর হাঁচি, কাশি থেকে উৎপন্ন ড্রপলেট শ্বাসনালীর মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের সময় একজন সুস্থ ব্যক্তিকে সংক্রমিত করে। যক্ষ্মা রোগীর কফ থেকেও ড্রপলেটের মাধ্যমে যক্ষ্মার সংক্রমণ ঘটে। অন্যান্য উৎস যেমন যক্ষ্মা রোগীর মল-মূত্র ইত্যাদি থেকে যক্ষ্মা সংক্রমণ ঘটতে পারে, তবে তা বেশ জটিল। অনেকে মনে করেন যক্ষ্মা বা টিবি আক্রান্ত রোগীর পাশে বসলেই যক্ষ্মার সংক্রমণ ঘটে। বৈজ্ঞানিকভাবেই এই ধারণাটি ভুল। যক্ষ্মা সংক্রমণে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এ রোগের জীবাণু পরিবেশে অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে। বদ্ধ স্যাঁতস্যাঁতে ও জনাকীর্ণ পরিবেশে যক্ষার জীবাণু খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়। উজ্জ্বল ও পরিষ্কার পরিবেশে যক্ষ্মার জীবাণু বেশি সময় বাঁচে না। যে কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- হোস্টেল, ব্যারাক ইত্যাদি এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে যক্ষ্মার প্রকোপ অপেক্ষাকৃত বেশি। পুষ্টিহীন শরীরে সংক্রমিত জীবাণু খুব দ্রুত রোগের সৃষ্টি করে। এ জন্য বিভিন্ন রোগ যেমন ডায়াবেটিস, কিডনি ফেইলর, লিভার ফেইলর ইত্যাদি যেখানে পুষ্ঠিহীনতার প্রকাশ বেশি এ সমস্ত রোগাক্রান্ত মানুষের মধ্যে ও যক্ষ্মা রোগের প্রকোপ বেশি। মূলতঃ কাশি যক্ষ্মা রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ বা উপসর্গ। কাশির সাথে অল্প বা বেশি পরিমাণে কফ যেতে পারে। অনেক সময় কাশির সাথে রক্তও যেতে পারে। যক্ষ্মা রোগীর ক্ষেত্রে রক্তে রং উজ্জ্বল লাল হয়ে থাকে। কাশি ছাড়া যক্ষ্মা রোগীর অন্যান্য উপসর্গসমূহ যেমন ঃ জ্বর আসা, খাবারে অনীহা, দ্রুত ওজন হ্রাস, বিষাদময়তা ইত্যাদি অন্যতম। যক্ষ্মা রোগে-এর সাধারণতঃ সন্ধ্যায় বা রাত্রে জ্বর আসে, জ্বর ছাড়ার সময়-প্রচুর ঘাম হয়-এবং সকালের দিকে জ্বর থাকে না।
জাতীয়-যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ-কর্মসূচি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির তিন সপ্তাহ বা অধিক সময়-কাশি থাকলে নিকটস্থ যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা ব্র্যাক সেন্টার বা কোনো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। দ্রুত রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে সঠিক চিকিৎসা নির্দিষ্ট সময়কাল ধরে গ্রহণ করলে যক্ষ্মা দ্রুত নিরাময় করা যায়, যক্ষ্মা রোগজনিত শারিরিক ক্ষতি কমানো যায় এবং যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণ বহুলাংশে হ্রাস করা যায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কফ পরীক্ষার মাধ্যমে যক্ষ্মা বা টিবি রোগ সনাক্ত করা যায়। কফের মধ্যে জীবাণু পাওয়া গেলে-রোগের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়। কফে জীবাণু পাওয়া না গেলে অন্যান্য আরো অনেক আধুনিক পরীক্ষার মাধ্যমে যক্ষ্মা বা টিবি রোগ নিরূপণ করা যায়। অতি সম্প্রতি মহাখালীস্থ আন্তর্জাতিক উদরাময়-গবেষণাকেন্দ্র যক্ষ্মা বা টিবি রোগ নির্ণয়ের অধিকতর কার্যকর পরীক্ষা উদ্ভাবন করেছে, যা এক্ষেত্রে এদেশের বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত সাফল্য।
যক্ষ্মা বা টিবি রোগ হলে দুঃশ্চিন্তা করার বা ঘাবড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। ডাক্তার ও রোগীর সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে-যক্ষ্মা বা টিবি রোগ-নিরাময় করা সম্ভব। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে ধৈর্য সহকারে এ রোগের জন্য চিকিৎসা নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও জাতীয়-যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ-কর্মসূচির সমন্বিত উদ্যোগে যক্ষ্মা বা টিবি রোগ চিকিৎসার একটি সুন্দর চিকিৎসা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে, যা অনুসরণ করে যক্ষ্মার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। বাংলাদেশ সরকার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য পুরো চিকিৎসার ওষুধ বিনামূল্যে দিয়ে থাকে। যাতে অর্থের অভাবে কোন রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত না হয়।
যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় সাফল্যের জন্য ডাক্তার ও রোগীর সুসমন্বিত-প্রয়াসের পাশাপাশি এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আবশ্যক। চিকিৎসককে রোগীদের এ রোগ সম্পর্কে ভালো ধারণা দিতে হবে, এ রোগের চিকিৎসা ও চিকিৎসার সময়-ঠিকমতো চিকিৎসা না নেয়ার কুফল- চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সাথে-যুক্ত থাকার গুরুত্ব ইত্যাদি ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। যক্ষ্মা বা টিবি রোগের ওষুধগুলো উচ্চমাত্রার বিধায় এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রোগীকে অবহিত করতে হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে রোগীর করণীয় বিষয়েও রোগীকে ভালোভাবে বুঝাতে হবে। রোগীকে নিয়মিতভাবে মাঠকর্মীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে-রাখতে হবে-যাতে তারা চিকিৎসা প্রক্রিয়া থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন না হয়। অনিয়িমিত ওষুধ গ্রহণ বা নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করার ফলে-নিরাময়যোগ্য যক্ষ্মা বা টিবি রোগ কষ্টসাধ্য নিরাময় ও ব্যয়বহুল মাল্টিড্রাগ রেসিট্যান্ট টিবিতে মোড় নেয়, যা এ রোগের একটি ভয়াবহ পর্যায়। তাই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। যক্ষ্মা বা টিবি রোগের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে নিম্মোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে ঃ
-বাসস্থানের পরিবেশ যথাসম্ভব খোলামেলা, আলো-বাতাস সম্পন্ন হতে হবে।
-জনাকীর্ণ বাসস্থান যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
– যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে সবসময়-নাক মুখ ডেকে চলাফেরা করতে হবে।
-যক্ষ্মা জীবাণুযুক্ত রোগীর সাথে আলাপচারিতার সময় একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
-রোগী জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে অন্য সবার থেকে একটু আলাদা ভাবে রাখাই ভালো।
– জীবাণুযুক্ত রোগী যেখানে সেখানে-কফ ফেলা পরিহার করতে হবে।
-নিয়মিত কফ পরীক্ষার মাধ্যমে জীবাণু মুক্ততা নিশ্চিত করতে হবে।
পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসকারী রোগের সুষ্ঠু চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে একথা বলা যায়-সমন্বিত প্রয়াস, যক্ষ্মামুক্ত শ্বাস। আসুন আমরা সকলে যক্ষ্মা প্রতিরোধে সচেষ্ট হই।
ডাঃ এ কে এম মোস্তফা হোসেন
পরিচালক
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
মহাখালী, ঢাকা-১২১২।

আরও পড়ুনঃ   বসন্তের যাতনা জলবসন্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

17 − 3 =