মজহার হোসেন: বন্ধ হয়ে গেছে নওগাঁ জেলার ৪টি উপজেলার বৈকালিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম। আড়াই বছর আগে ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ জেলার মান্দা উপজেলায় এই কার্যক্রম প্রথম শুরু হয়। জনদুর্ভোগ লাঘবে এই কার্যক্রমের স্বপ্নদ্রষ্টা ঐ নির্বাচনী এলাকার সাংসদ, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক। প্রবীণ এই সাংসদ একান্ত আলাপচারিতায় একদিন তার স্বপ্নের কথা জানান। তিনি বলেন, কৃষি প্রধান এই অঞ্চলের মানুষের দিনের শুরুই হয় মাঠের কাজ দিয়ে। ফসলি জমি চাষে পুরুষের পাশাপাশি এখন নারীদেরও অবাধ অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র/ ছাত্রীদের সরব উপস্থিতিও সেই সকাল থেকেই শুরু হয়। উপজেলা পর্যায়ের অফিস আদালতগুলোতেও কাজের শুরু সকালেই। সকালের দিকে রুটি-রুজির কাজে ব্যস্ত থাকেন নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ। কাজেই চিকিত্সার জন্য স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা যেতে পারেন না। যারা যান তাদের যেতে হয় নানান কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে। এই সবকিছু বিবেচনায় বৈকালিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা বিষয়টি তিনি আমাকে ভেবে দেখতে বলেন। কালবিলম্ব না করে তার এই স্বপ্নের কথা নিয়ে আমি খোলামেলা আলোচনা করি ৩৩তম বিসিএস-এ চাকরি পাওয়া তরুণ চিকিত্সকদের সাথে। এতে সবাই স্বত:স্ফূর্ত সাড়া দেন। শুরু হয় বিকালে রোগী দেখার কাজ। প্রথমে শুধু আউটডোর সার্ভিস দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এই কার্যক্রমে জনগণের ব্যাপক সাড়া দেখে এর সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার অন্যান্য বিষয়—এক্স-রে, প্যাথলজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম এসবকিছুও যুক্ত হয়। চিকিত্সকদের পাশাপাশি অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগী হন। দিন দিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের উপস্থিতির হার অনেক বেড়ে যায়। দুই বছরে এখানে রোগী দেখা হয় প্রায় লক্ষাধিক।
বৈকালিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম : একটি সফল প্রয়াসের মৃত্যু!
মান্দার এই সাফল্যের পর বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু হয় বদলগাছি উপজেলায় ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি নিজে উপস্থিত থেকে এগারটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত জেলার পত্নীতলায় এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহাদেবপুর উপজেলায় সেখানকার সাংসদ ছলিম উদ্দিন তরফদারের সঙ্গে টেলি কনফারেন্স-এর মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। সেদিন ছিল ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর। জেলার সিভিল সার্জন হিসেবে সেই দিনটি ছিল আমার শেষ কর্মদিবস। এরপর আর আমি আর কিছু করে যেতে পারিনি। এখন জেনেছি, এই অত্যন্ত জনমুখী ও ফলপ্রসূ কর্মসূচিটি বন্ধ হয়ে গেছে। হূদয়ে এখন আমার রক্তক্ষরণ।
যে স্বপ্ন দেখলেন মন্ত্রী মুহাঃ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক আর অদম্য উদ্যোগ নিয়ে যার বাস্তবায়ন শুরু করলাম তার একি হাল! স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এই কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে আমি বিকল্প নেতৃত্ব বানানোর সময় ও সুযোগ পাই নি। চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তেমন আন্তরিক কাউকে পাইনি। এছাড়া চিকিত্সকদের মধ্যেও কেউ কেউ এই কর্মসূচিকে আড় চোখে দেখেছেন। আমি সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম, সফলও হয়েছিলাম। আমাকে দৃঢ় ও সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
কী আশা নিয়েই না বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করেছিলাম আমরা। কী হবার কথা ছিল আর এখন কী হচ্ছে। কেউ দেখার নেই। কেউ এটিকে নিজের কর্মসূচি বলে ভাবেন না। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যখাতে অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে। একসঙ্গে ছয় হাজার গ্রাজুয়েট ডাক্তারের পদায়ন ও দশ হাজার নার্সের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চল্লিশ হাজার কর্মচারী নিয়োগের ঘোষণাও সরকারের দায়বদ্ধতারই প্রমাণ। পরিতাপের বিষয়, সারা দেশতো নয়ই, নওগাঁ জেলাতেই তা পূর্ণভাবে হয়নি বরং জেলার যে চারটি উপজেলায় এ কর্মসূচি চালু হয়েছিল তা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। কেন? এই কেন-এর উত্তর কর্মসূচির প্রতি অনাগ্রহ, উদাসীনতা সর্বোপরি সংশ্লিষ্টদের গাছাড়া ভাব। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৈকালিক আউটডোর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমি আজকে পত্নীতলা উপজেলায় বৈকালিক আউটডোর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম উদ্বোধন করতে পেরে গর্ববোধ করছি। আমি আশা করি এই বৈকালিক আউটডোর স্বাস্থ্য কার্যক্রম দেশের সকল হাসপাতালে বিস্তৃত হবে। এখন এই বিস্তৃতির বদলে বন্ধ কি মেনে নেওয়া যায়?
লেখক : সাবেক সিভিল সার্জন