বিবাহ বিচ্ছেদ-প্রথম অংশ

0
978
বিবাহ বিচ্ছেদ

বিবাহ বিচ্ছেদে রয়েছে হাহাকার, শূন্যতা, উদ্বেগ, অসহায়ত্ব আর প্রতিহিংসা। যে পবিত্র আবেগ নিয়ে নারী-পুরুষ সংসার শুরু করে, বিচ্ছেদের করুণ পরিণতি সেই আনন্দ সাগরে নিয়ে আসে নোনাজল। বিচ্ছেদ স্বামী-স্ত্রী কারোরই কাম্য নয়। তারপরও অপ্রত্যাশিতভাবে বিচ্ছেদ এসে সংসার তছনছ করে দেয়। স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কে বৈষম্যের ফাঁক ধরেই মাথা তোলে বিচ্ছেদ। একদিনে নয়, প্রতিদিন একটু একটু করে ভেঙে বিচ্ছেদ ছায়া ফেলে। অনেকদিনের জমানো ক্ষোভের পুঞ্জিভূত দাবানল সংসারের সমস্ত আনন্দকে মুহূর্তেই চুরমার করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তুলে দেয় অশান্তির দেয়াল। ডিভোর্স-তালাক বা বিচ্ছেদের মধ্যে অর্থগত পার্থক্য কিছুটা থাকলেও ভাবগত তেমন পার্থক্য নেই। তাই অনেক বিচ্ছেদের ঘটনার ডিভোর্স বা তালাক অথবা আইনগত ত্যাগের বিষয়টি না থাকলেও সাদামাঠা বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অনেক জীবন পার করে দিচ্ছেন এমন দৃষ্টান্ত বর্তমান বিশ্বে ভুরি ভুরি। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বর্তমান কোনও বড় রকম কারণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে বিচ্ছেদ এখন মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর খুঁটিনাটি সমস্যা হলেই বিচ্ছেদ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। শুধুু উন্নত বিশ্বেই নয়, এশিয়ার দেশগুলোতে এমনকি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও বেশিরভাগেই বিচ্ছেদ ঘটছে অতি তুচ্ছ কারণে। তবে এদেশের বিগত দশ বছরের তালাক পরিসংখ্যানকে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ তালাকের কারণ হিসেবে স্ত্রীরা স্বামীর আর্থিক অসঙ্গতিকে দায়ী করেছেন এবং স্বামীর স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের যৌন অক্ষমতাকে দায়ী করেছেন। তবে জীবন-যাপনের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিচ্ছেদেও রয়েছে নানা কারণ।

উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্ত মানুষের কাক্সিক্ষত জীবন যেমন এক নয়, বিচ্ছেদের কারণও তেমন এক নয়। সংসারের প্রেক্ষাপট যেমন ফারাক আছে, বিচ্ছেদের মধ্যেও রয়েছে তেমন ভিন্নতা। উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে পরকীয়, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, স্ত্রীর স্বাধীনতা বিয়ে বিচ্ছেদের প্রধান কারণ। মধ্যবিত্তের বেলায় পরকীয়ার সাথে রয়েছে স্বামীর ভরণ-পোষণ করতে না চাওয়া বা না পারা। নিজ বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতি চরম পক্ষপাতিত্ব, স্ত্রীর মমতাকে প্রাধান্য না দেয়া। নিম্ন বিত্তের রয়েছে অর্থনৈতিক টানাপড়েন, শারীরিক নির্যাতন। তবে এ তিন শ্রেণীর পরিবারের বেলায় অভিন্ন ও জোরালো কারণটি হলো যৌতুক। আবার নারীর পক্ষে বিচ্ছেদ ঘটানোর প্রবণতা বেশি, যারা স্বাবলম্বী, প্রচ- ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তাদেরই। অন্যরা পড়ে পড়ে মার খায়। আজকাল এনজিও ও অন্যান্য আইন সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা   মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়ায় বলে নারীরাও বিচ্ছেদে পিছ-পা হয় না। বিচ্ছেদের অর্থ অশান্তি হলেও বিশ্বের দেশে দেশে কালে কালে ’যে সব বিচ্ছেদ ঘটেছে তার অনেকগুলো অতি ঠা-া মাথার এবং শান্তিপূর্ণ বিচ্ছেদের মধ্যে পড়ে। অবশ্য মনোবিজ্ঞানীদের একাংশ স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদকে শান্তিপূর্ণ মুক্ত জীবনের সন্ধান বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে-স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি ও যন্ত্রণাময় অবস্থায় একমাত্র অবসানের পথই হলো বিচ্ছেদ। সেক্ষেত্রে বিচ্ছেদকে তারা স্বাধীন জীবন-যাপনকারীর জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন। সংসার করতে চাইলেও অনেকে সংসারের মতো ছক বাঁধা জীবনকে ঝামেলা মনে করেও সংসার ত্যাগ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা সন্ন্যাসী বা ব্রাহ্মচারী হয়ে আশ্রমবাসী হন, তাদের এক ব্যাপকসংখ্যক মানুষই সামান্য সমস্যাকে কেন্দ্র করে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে চলে যান আশ্রমে। অনেকে একেবারেই তুচ্ছ কারণে বিচ্ছেদ ঘটান। কিন্তু তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বাদে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় থাকে। সে কারণে মনোবিজ্ঞানীরা বিচ্ছেদকে নানা রঙের, নানা ধরনের ও বহুমাত্রার খামখেয়ালিপনা বলে গণ্য করেন।

একই পরিবারের তিন বোনের বিবাহ বিচ্ছেদ

বিচ্ছেদের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের ধারণা এবং প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারীর চেয়ে পুরুষরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয় এবং এক পর্যায়ে তারা তার সহধর্মিনীটিকে ডিভোর্স বা তালাক দেয়। কিন্তু এই চিত্র বর্তমান পাল্টে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে অনেক আগে থেকেই নারীরা তার স্বামীকে ডিভোর্স করার প্রবণতায় এগিয়ে গেলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ছিল উল্টো চিত্র। এখানে পুরুষরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীদের ডিভোর্স করার সিদ্ধান্ত নিতো এবং করতোও। কিন্তু বর্তমানে এশিয়ার সব দেশ তো বটেই, সঙ্গে বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা দেশের বৃহদাংশ অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারীরাও এখন ডিভোর্সের ব্যাপারে স্বসিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে। দেশে অনেক উদারহণ হয়তো আছে। কিন্তু একই পরিবারের তিন বোন স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে বাপের বাড়িতে জীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা দেশে বিরল। সুষমা, বারুন ও ছোট্টু নামের এই তিন বোনের জন্ম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অজপাড়া গাঁয়ের এক নিভৃত পল্লীতে। খুলনার পাইকগাছার লস্করগ্রামের এক নিম্ন বিত্ত পরিবারের মেয়ে এরা। সুষমার বর্তমান বয়স ৪৫। প্রায় ৩০ বছর আগে বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী গ্রাম খড়িয়ার ম্যামাপ্রসাদের সঙ্গে। বছর পাঁচেক সংসার করার পর তুচ্ছ কারণে সুষমা স্বেচ্ছায় স্বামীকে ছেড়ে চলে আসেন বাপের বাড়িতে। এলাকায় প্রচলিত তথ্যমতে জানা যায়, বিয়ের আগেই কিশোরী সুষমা তার বাপের বাড়ির এক ছেলের প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রেম রক্ষার্থে সুষমা সংসারের মায়া ত্যাগ করে বাপের বাড়ি এসে দর্জির কাজ করে জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু সে ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি। বা অন্য কাউকেও বিয়ে করেননি। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং ¯েœহপরায়ন সুষমা বাপের বাড়ি কাটালেও তার বিরুদ্ধে মানুষের কোনও অভিযোগ নেই। বরং এলাকায় তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। পরপর দু’বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। এদিকে সুষমার স্বামী শ্যামাপ্রসাদ দীর্ঘ ছয় বছর অপেক্ষা করে দ্বিতীয় বিয়ে করলেও আজ অবধি সুষমাকে ঘরে নেয়ার জন্য রয়েছেন উদগ্রীব। এমনকি সুষমার সতীনের ছেলে সুষমাকে বড় মা বলে ডেকে তাকে বাড়ি নিয়ে যাবার চেষ্টা করেও আর নিয়ে যেতে পারেনি। বছর দেড়েক আগেও তিনি সুষমাকে নিতে এলে সুষমা আর ফিরে যাননি। সুষমার এই বিচ্ছেদের বড় কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই পরিবারে তার কাকতো বোন বারুনের বর্তমান বয়স ৪২। বিশ বছর আগে প্রশান্ত নামের একজনের সঙ্গে তার প্রথম বিয়ে হয়। প্রশান্ত ছিল শঠ প্রকৃতির। তার শঠতার শিকার হয়ে বারুন সে ঘরে টিকতে পারেননি। কয়েক বছর পর পাশের গ্রামের অসীম নামের এক ছেলের সঙ্গে আবার বিয়ে হয়। কিছুদিন সেখানে সংসার করার পর চলে আসেন বাপের বাড়িতে। স্বেচ্ছায় অসীমকে ত্যাগ করে চলে যান কলকাতায়। সেখানে বাসায় কাজের সুবাদে প্রেম হয় এক ধনীর দুলালের সঙ্গে বিয়ের শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বারুন। বছর পাঁচেক পর ফিরে আসেন স্বভূমে। পরে অনেকে বিয়ে করতে চাইলেও আর বিয়ে করেননি। তবে আশ্চার্যজনকভাবে তার দ্বিতীয় স্বামী অসীম বেশ কয়েক বছর ধরে তাকে ঘরে তুলে নেবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। বারুন অসীমকে কেন ত্যাগ করে এসেছিলেন, সে রহস্য আজও সবার অজানা। অতিকষ্টে বাপের ভিটেতে কোনও রকমে জীবন কাটছে বারুনের। এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে চালের ব্যবসা করে চলে তার দিন। তবুও স্বামীর ঘরে আর ফেরেননি বারুন। বারুনের আপন ছোট বোনের নাম ছোট্টু। বর্তমান বয়স ২৮। বছর দশেক আগে বিয়ে হয় ভারত প্রবাসী এক চোখ অন্ধ এক ছেলের সঙ্গে । স্বামীর সঙ্গে ভারতে গিয়ে বছর দুয়েক সংসার করে ফিরে আসেন স্বদেশে বাপের বাড়িতে। তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। স্বামী তাকে অনেক চিঠি লিখেছেন। অনেকবার নিয়ে যাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন। ছোট্টুও কামলা খেটে কষ্টে জীবন চালাচ্ছে। একই পরিবারের তিন বোন যেহেতু একই পথের পথিক। স্বামী সংসার ছেড়ে বাপের বাড়িতে অতি কষ্টে দিন কাটিয়ে দেয়ার মধ্যেই তাদের এই আনন্দকে জিনগত সমস্যা বলে ধারণা করেন এলাকার অনেকেই। সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো, এই পরিবারের বারুনের আর একটি ছোট বোন রেখা (৩১) ইচ্ছাকৃতভাবে বিয়ে করেননি। কারণ তার সন্দেহ রয়েছে বিয়ের পর যদি স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে বাপের বাড়ি এসে উঠতে হয়। ঘটনা যাই হোক, একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো, এদেশের পাড়াগাঁয়ের নিম্ন বিত্ত পরিবারের নিরক্ষর মেয়েরাও যে তাদের পছন্দমতো স্বামী না হলে সম্পর্কচ্ছেদ করে, সংসার ত্যাগ করে কষ্টের জীবন বেছে নিতে পারে এটাই বিস্ময়ের।

আরও পড়ুনঃ   যৌতুক : কনের অশ্রু, বরের উল্লাস

তালাকে মেয়েরা এগিয়ে

দেশে বর্তমান পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তালাকের ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী যত এগিয়ে আসছে ততই বিয়ে বিচ্ছেদে তারা সোচ্চার হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নারীকে পুরুষরা নির্যাতনও কম করে। সেই সাথে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোর আইনি সহায়তাও নারীকে সাহসী করে তালাকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সালিশ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে তালাকের ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। সালিশি বোর্ডের তথ্যানুযায়ী গত ১৪ বছরে রাজধানীতে ২০ হাজার ৬৫৩টি বিচ্ছেদের ঘটনা রেজিস্ট্রি হয়েছে। যার মধ্যে ১৪ হাজার ৯১১টি তালাক দেয়া হয়েছে মেয়েদের পক্ষ থেকে। বাকি ৫ হাজার ৭৪২টি দিয়েছে পুরুষ। সালিশি বোর্ড আরো জানায়, নগরীর মোট তালাকের মধ্যে গত ১১ বছরে ৭০ দশমিক ৮৫ ভাগ তালাক দেয়া হয়েছে মেয়েদের পক্ষে এবং বাকি ২৯ দশমিক ১৫ ভাগ দেয়া হয়েছে পুরুষের পক্ষ থেকে। শহরের বস্তি এলাকায় বাইরের সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারেই ঘটেছে এ বিচ্ছেদের ঘটনা। তবে নারীর পক্ষ থেকে তালাক নোটিশ পেয়ে পুরুষমাত্রই যে মেনে নিচ্ছে তা নয়। তারা মামলা-মোকদ্দমাসহ দৈনিক আক্রমণ করতেও পিছপা হয় না। ২০০৪ সালের ৯ মে রূপগঞ্জের কবরস্থান এলাকার শাহাজালাল লিটন (৩০)কে তার স্ত্রী পারভীন আক্তার কবি তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, খবর পেয়ে লিটন তার শ্বশুরবাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ঘটনায় দিন তালাক দেয়ার উদ্দেশ্য ববি নারায়ণগঞ্জ যায়। খবর পেয়ে লিটন শ্বশুরবাড়িতে হামলা চালিয়ে রঙিন টিভি, ভিসিডিসহ আনুমানিক ২ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে আসে। পরে পুলিশ লিটনকে গ্রেফতার করে। এরকম ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা গ্রামের এক ভারতীয় পাত্রীর বেলায়ও। জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ভারতের  পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটের ফজলুল করিমের মেয়ে তাসমিরার সঙ্গে বিয়ে হয় বাংলাদেশের সাতক্ষীরার ঘোনা গ্রামের শুকুর আলীর পুত্র আব্দুল মকিদের। দীর্ঘ ৬ বছর সংসার জীবনে তাদের দু’টি সন্তান হয়। দুই দেশের দুই পরিবারের আত্মীয়তার মধ্যে কোনওরকম খাদ পড়েনি কখনও। হঠাৎই তাসমিরা আর মকিদের মধ্যে শুরু হয় বিবাদ। তাসমিরার অভিযোগ, মকিদ সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে সে অনেকদিন ধরে তাকে ঐ পথ থেকে সরে আসার অনুরোধ করলেও মকিদ ফিরে আসেনি। এ অবস্থায় তার পক্ষে মকিদের সঙ্গে সংসার করা সম্ভব নয় বলে সে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেয়। এক সময় কোলের বাচ্চা ছেলেটি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। মকিদ তার কয়েকজন বন্ধু ও ভাইদের নিয়ে বসিরহাটে গিয়ে তাসমিরাকে জোর করে নিয়ে আসার চেষ্টা চালালে সেখানকার স্থানীয় ক্লাবে সালিশ বসে। সালিশে তাসমিরার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে সে মকিদের সঙ্গে সংসার করবে না বলে জানায়। মকিদ কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করে ক্লাবের সদস্যদের টাকা দিয়ে প্রভাবিত করে তাসমিরাকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তাসমিরা সাতক্ষীরা জজ আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাকে ডিভোর্সের আবেদন জানায়। ঐ দিন রাতে মকিদ তাসমিরাকে বেদম প্রহার করে। তাসমিরা গুরুতর আহত হয়। হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং স্থানীয় নারী কল্যাণ  উদ্যোগ নামের একটি সংস্থা তাসমিরাকে আইনি সহায়তা দিয়ে তার ডিভোর্স কার্যকর করে কয়েকদিনের মধ্যে বাপের বাড়ি ভারতের বসিরহাটে পাঠিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনঃ   সুখী দাম্পত্যের দশ টিপস

ডিসিসি’র তালাক পরিসংখ্যান

ঢাকা সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, গত বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে সর্বাধিকসংখ্যক তালাকের আবেদন জমা পড়ে সিটি কর্পোরেশনে। মোট ৬ হাজার ৩২৪টি আবেদন পড়ে। এরমধ্যে ৫ হাজার ৩২৭টি তালাক মঞ্জুর করা হয়। তালাকের মধ্যে মেয়েদের পক্ষ থেকে ২ হাজার ৮৭৬টি কার্যকর হয়। বাকি ২ হাজার ৪৫১টি পুরুষদের পক্ষ থেকে তালাক দেয়া হয়। ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৮৭৩টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২ হাজার ১২টি মেয়ে পক্ষ থেকে। বাকিগুলো পুরুষ পক্ষ থেকে ঘটে। ২০০৩ সালে ৩ হাজার ২০০টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। ২০০২ সালে তালাকের আবেদন করেছে ৩ হাজার ৭১২টি, কার্যকর হয়েছে ২ হাজার ৬শ’ ১৫টি। ২০০১ সালে ২ হাজার ৯শ’ ১৬টি, কার্যকর হয়েছে ২ হাজার ৫শ’ ৪০টি। ২০০০ সালে বিয়ে বিচ্ছেদের ২ হাজার ১০টি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৯২টি বিয়ে বিচ্ছেদই ঘটানো হয় নারীর পক্ষে। এ বছর ছেলেরা তালাক দেয় ৬১৮টি। ১৯৯৯ সালে বিয়ে বিচ্ছেদের রেকর্ড হয় ১ হাজার ৭৫২টি, যার মধ্যে ১ হাজার ২১২টি বিচ্ছেদ ছিল মেয়ের পক্ষ থেকে। ঐ বছর ছেলেদের পক্ষ থেকে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটানো হয় মাত্র ৫৪০টি। ১৯৯৮ সালে ১ হাজার ৭৯৩টি তালাক রেকর্ড করেছে সিটি কর্পোরেশন সালিশ বিভাগ। যার মধ্যে মেয়েদের পক্ষ থেকে দেয়া হয় ১ হাজার ৩৬০টি। আর পুরুষের পক্ষ থেকে ৪৩৩টি। ’৯৭ সালে ১ হাজার ৬৭০টি তালাকের ঘটনায় নারীরাই দিয়েছে ১ হাজার ৫টি, বাকি ৬৬৫টি পুরুষরা। ১৯৯৬ সালে একইভাবে নারীরা এ কাজে এগিয়ে ছিল। এ বছর রেকর্ডকৃত ১ হাজার ৯২৫টি তালাকের মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে ৫২৫টি। ১৯৯৫ সালে মেয়েদের পক্ষ থেকে ৯১০টি তালাক দেয়া হলেও ছেলেদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে মাত্র ৩৫৫টি। ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৫৬৯টি বিয়ে বিচ্ছেদের মধ্যে ছেলেদের পক্ষে বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে মাত্র ৩৭০টি। ঐ বছর মেয়েদের পক্ষ থেকে বিচ্ছেদ ঘটানো হয় ১ হাজার ১৯৯টি। ১৯৯৩ সালে ১ হাজার ৩২০টি তালাকের মধ্যে পুরুষরা দিয়েছে ৩০৫টি। আর মেয়েরা দিয়েছে ৯৬৮টি। ১৯৯২ সালে ১ হাজার ৩১৫টির মধ্যে মেয়েরা দিয়েছে ১ হাজার ৩৫টি তালাক। ১৯৯১ সালে ১ হাজার ৭৭২টি তালাকের মধ্যে মেয়েরাই দিয়েছে ১ হাজার ৩৯২টি আর বাসি ৩৮০টি তালাক দেয়া হয়েছে পুরুষদের পক্ষ থেকে।

নারী-পুরুষের অভিযোগসমূহ

নারীরা তাদের তালাক প্রবণতার কারণ হিসেবে তিনটি অভিযোগের উপর জোর দিয়েছেন। এগুলো হলো যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং পরনারী আসক্তি। অন্যদিকে পুরুষরা বিচ্ছেদের প্রধান কারণ হিসেবে নারীর যৌন অক্ষমতাকে দায়ী করেছেন। প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিলে দেনমোহরের টাকা, ভরণপোষণ দিতে হবে, বা”্চাদের দায়িত্বও নিতে হবে। তাই কোনমতে প্রথম স্ত্রীকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি নিলে ঝামেলা থাকে না। তবে দেনমোহর ও খোরপোষ নিয়েও পোহাতে হয় ঝামেলা। লালমাটিয়ার কাজী অফিসের সহকারী কাজী মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জানান, তার ১৬ বছরের পেশাগত জীবনে মোহরানার টাকা আদায় হয়েছে এমন শোনেননি। এ টাকা আদায়ে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। নিয়ম রয়েছে মোহরানার ওপর শতকরা ১ ভাগ টাকা প্রদান করার। খোরপোষ ও দেনমোহর সম্পর্কে এডভোকেট হাবিবুন্নেসা বলেন, মুসলিম আইনে দেনমোহরের ক্ষমা নেই। তা স্বামীকে দিতেই হবে। একটা পয়সাও ক্ষমা নেই। কিন্তু বাস্তবে তা খুব কম স্ত্রীই পায়। দুর্নীতির জন্য তা পায় না। তালাকের চূড়ান্ত  ও একক ক্ষমতা স্বামীর হাতে। শর্তসাপেক্ষে স্ত্রী কিছু ক্ষমতা পায়। ৬১ সালে প্রণীত আইনের খোলা তালাকের সমঝোতার মাধ্যমে স্ত্রীর ওপর কিছুটা অধিকার বর্তায়। তিনি বলেন, আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি মামলা করে খোরপোষ আদায় হয় খুব কম। বরং এনজিও ও চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সমঝোতায় ’ছিটেফোটা টাকা আদায় হয়। যে কারণেই তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত পুরুষ নিক না কেন, অভিযোগনামায় স্বামীদের পক্ষ থেকে স্ত্রীকে ‘চরিত্রহীনা’ আখ্যায়িত করা ‘অভিন্ন’ কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এরপরের কারণ হিসেবে স্ত্রী অবাধ্যÑ এ কথাটিতেও জোর দেয়া হয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সালিশ বোর্ড সূত্রে এসব জানা যায়। সূত্র আরো জানায়, এছাড়া আর যে সব কারণ পুুরুষ তালাকের জন্য ‘ঢাল’ হিসেবে তুলে ধরে তার মধ্যে রয়েছে প্রথম স্ত্রী সন্তান প্রসবে অক্ষম, নতুবা পুত্র সন্তান হয় না কিংবা প্রথম স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ। প্রথম স্ত্রী যৌন কাজে অক্ষম। এ অভিযোগটি সব আবেদনেই রয়েছে। তবে দ্বিতীয় বিয়ের হার কমেছে বলে প্রধান আইন কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান জানান। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চলতি বছর এ পর্যন্ত ১টি আবেদন জমা পড়েছে। ২০০৫ সালে ৯টি ও ২০০৪ সালে ১১টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র ২টি বাদে অন্যগুলো অনুমোদন দেয়া হয়। ২০০৩ সালে ৮টি আবেদনপত্র পড়ে, ৭টির অনুমতি দেয়া হয়, ১টি খারিজ হয়ে যায়। ২০০২ সালে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি চেয়ে ১৭টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। ১৫ জনকে বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়।

আরও পড়ুনঃ   দাম্পত্য জীবন সুখী করার কিছু গোপন রহস্য!

২০০১ সালে আবেদনপত্র ১১টি অনুমতি দেয়া হয়। পূর্ব রামপুরায় বসবাসরত চিকিৎসক মামুন স্ত্রীর বিরুদ্ধে অসুস্থতার অভিযোগ এনে সালিশি পরিষদে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি চায়। তিনি অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী বিয়ের আগেই অপারেশন করে একটি স্তন ফেলে দেয়। কিন্তু বিয়ের সময় একথা গোপন রাখে। চিকিৎসক মামুন তার আবেদনপত্রে লেখেন, স্ত্রী স্তন ক্যান্সারের রোগী, তা তিনি বিয়ের রাতেই জানতে পেরেছেন। ’৯৮ সালে তাদের বিয়ে হয় বিয়ের রাতে তিনি একথা জানতে পারলে স্ত্রী তার পা ধরে কান্নাকাটি করে। তারপরও তিনি স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইতোমধ্যে তাদের এক কন্যা জন্ম নেয়। ডাঃ মামুন আবেদনপত্রের শেষে লেখেন, আমি এক হতভাগ্য যুবক। জৈবিক চাহিদা পূরণে আমার স্ত্রী অক্ষম। তাই আমি দ্বিতীয় বিয়ের আবেদন করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ইশরাত শামীম পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ের প্রবণতা ও সালিশি বোর্ডের কাছে অনুমতি নেয়া প্রসঙ্গে বলেন, বিবাহ আইনে অনুমতি নেয়ার কথা হয়েছে। বলেই সাধারণত অনুমতি নেয়া হয়। তাছাড়া ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনুমতি নেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রী কেন অনুমতি দিচ্ছেন এবং দ্বিতীয়  স্ত্রী কেন বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন এ বিষয়টি দেখা দরকার। নি¤œবিত্ত সমাজের পুরুষরা সমাজকে তোয়াক্কা করে না বলে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও মনে করে না। আর যে দেশে নারী সহিংসতা তুঙ্গে, সেদেশের পুরুষরা দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি খুব তুচ্ছভাগেই গণ্য করে বলে তিনি জানান। ডিসিসি থেকে জানা গেছে, অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েও বিচ্ছেদের আবেদন জানায় কিনতু আবেদনে সে বিষয়টি লিখতে পারে না লজ্জার কারণে। তবে অনেকে প্রকাশ্যে তাদের স্ত্রী দ্বারা নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন। এদেশের গ্রামাঞ্চলেও অনেক পুরুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাদের স্ত্রীদের দ্বারা। মাদারীপুরের রাজৈর থানার মতিন মিয়া সরকারি চাকরি করেন ঢাকায়। তার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তিনি বলছেন, সপ্তাহে দু’দিন বাড়ি যাই একটু শান্তির আশায়। কিন্তু স্ত্রীর অত্যাচারে টিকতে পারি না। অত্যন্ত অমায়িক প্রকৃতির মতিন ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, এদেশে মেয়েরাই এখন পুরুষদের উপর নির্যাতন করছে অধিকমাত্রায়। মেয়েরা যদি বেশিসংখ্যায় স্বাবলম্বী হয়, তাহলে তাদের সঙ্গে সংসার করা কঠিন হয়ে পড়বে। (চলবে)

আখতার হামিদ খান

বিঃ দ্রঃ গুরুত্বপূর্ণ হেলথ নিউজ ,টিপস ,তথ্য এবং মজার মজার রেসিপি নিয়মিত আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে লাইক দিন আমাদের ফ্যান পেজ বিডি হেলথ নিউজ এ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × 5 =