বিপজ্জনক রোগ ভাইরাল হেপাটাইটিস

0
863
ভাইরাল হেপাটাইটিস,Viral Hepatitis

চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া, গাঢ় রঙের প্রসাব, ক্ষুধামন্দা, পেটে ব্যথাজনিত সমস্যাগুলো জীবনে একবারও হয়নি বাংলাদেশে এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্ট হবে। লোকমুখে এ সমস্যা জন্ডিস নামে পরিচিত। সমস্যাটি বুঝতে বাঙালি যতটাই পারদর্শী, সমস্যার সঠিক সমাধান নিতে ততটাই ব্যর্থ। হাসপাতালগুলোতে প্রায়ই এরকম রোগী দেখা যায়, যারা জন্ডিস ভেবে ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া ইত্যাদি গ্রহণ করে বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ রি-অ্যাকশন নিয়ে হাজির হয়েছেন। অনেকটা আগুন নিভাতে তেল ব্যবহারের দশা। জন্ডিস প্রকৃতপক্ষে রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। যেসব রোগে মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভার এবং লোহিত রক্তকণিকা আক্রান্ত হয়, সেসব রোগের অন্যতম লক্ষণ হিসেবে জন্ডিস দেখা দেয়। তবে অধিকাংশ রোগীদের ক্ষেত্রে যে রোগটি জন্ডিসের জন্য দায়ী তাহল হেপাটাইটিস; তথা লিভারের প্রদাহ। হেপাটাইটিস রোগের জন্য দায়ী কতগুলো হেটাটোট্রফিক ভাইরাস। এ পরিবারভুক্ত ভাইরাসগুলোকে বলা হয় হেপাটাইটিস ভাইরাস। ভাইরাসগুলো হলোÑ হেপাটাইটিস-‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ এবং ‘ই’। এ ভাইরাসগুলোকে সংক্রমণের মাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে দুইভাগে ভাগ করা যায় : প্রথমটি, দূষিত পানি ও খাদ্যবাহিত ভাইরাস হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ এবং অপরটি দূষিত রক্তের মাধ্যমে বাহিত ভাইরাস হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’ এবং ‘ডি’। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘ডি’ একা বাস করে না, বাস করে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের আবরণে, যেন মায়ের কোলে শিশু।

হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’

দূষিত পানি এবং খাবারের মাধ্যমে এই ভাইরাসদ্বয় ছড়ায়। তার ফলে রাস্তার ধারের খোলা খাবার, আখের রস, শরবত ইত্যাদি এ ভাইরাসে আক্রান্ত করার জন্য দায়ী। এছাড়া যারা শহরে বাস করেন, কিন্তু পানি না ফুটিয়ে পান করেন; যারা গ্রামেগঞ্জে টিউবওয়েলের পানির পরিবর্তে ডোবা-নালা-পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন এবং যারা এমন উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করেন যেগুলো পয়নিষ্কাশন-নালীর সাথে সংযুক্ত তারাও হেপাটাইটিস ‘এ’ বা ‘ই’তে আক্রান্ত হতে পারেন।

ভাইরাসদ্বয় পানি বা খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশের ১৫-৬০ দিন পর জন্ডিস দেখা দেয়। আমরা জানি, ভাইরাস কোষের ভেতর প্রবেশ করে কোষের ভেতরের ডিএনএ ও বিভিন্ন এনজাইম ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি করে। হেপাটাইটিস ভাইরাস লিভারের কোষকে আক্রমণ করে। ফলে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিয়োজিত কণিকাগুলোর মধ্যে শ্বেত রক্তকণিকা ও হিস্টিওসাইট লিভারের আক্রান্ত কোষকে নষ্ট করে দেয়ার মাধ্যমে ভাইরাসকে ধ্বংস করে দিয়ে সুস্থ কোষগুলোকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে।

লিভারের অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটি হলো মেয়াদোত্তীর্ণ হিমোগ্লোবিন ভেঙে বিলিরুবিন তৈরি করা এবং পিত্তনালির মাধ্যমে খাদ্যনালিতে বের করে দেয়া। কিন্তু লিভারের কোষ নষ্ট হলে এ বিলিরুবিন রক্তে প্রবেশ করে। ফলে রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে যায় এবং জন্ডিসের সময় আমাদের শরীরের হলুদ রঙের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া লিভার আক্রান্ত হলে ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, বমি, জ্বর, পেটের ডান দিকে বুকের নিচে ব্যথা ও অস্বস্থি জাতীয় সমস্যা হয়। তবে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাস সবাইকে সমান মাত্রায় আক্রান্ত করে না। এ কারণে রোগের লক্ষণের মাত্রায় ভিন্নতা দেখা যায়। ‘এ’ ভাইরাস সাধারণত শিশুদের বেশি আক্রমণ করে এবং বড়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় ‘ই’ ভাইরাসের শিকার। বড়দের ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ কমবেশি স্পষ্ট হলেও, শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময় রোগের লক্ষণ বোঝা যায় না। ভাইরাসদ্বয় দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায় বিধায় বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় মহামারির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বন্যার সময় হেপাটাইটিসের মহামারির জন্য দায়ী প্রধানত ‘ই’ ভাইরাস।

আরও পড়ুনঃ   হেপাটাইটিস এ -কারণ ,লক্ষণ ও প্রতিকার জেনে নিন

হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’কে বলা হয় সেল্ফ লিমিটিং ডিজিজ। অর্থাৎ আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এদের শরীর থেকে দূর করার জন্য যথেষ্ট এবং দুই থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্ডিস একা একাই সেরে যায়। প্রশ্ন হলোÑ এ সময়টিতে আমরা রোগীর জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি?

ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রথম চিকিৎসা হলোÑ শরীরের পরিপূর্ণ বিশ্রাম এবং স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা হলো জন্ডিস হয়েছে তাই বেশি বেশি ফলের রস, ডাবের পানি এবং খাবার পানি খেতে হবে, হলুদ মরিচ খাওয়া যাবে না। এটা সম্পূর্ণ ভুল। জন্ডিস হলে রোগীকে হলুদ, মরিচ, তরি-তরকারি, মাছ-মাংস স্বাভাবিক খাবার খেতে দিন। ফল, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি খাওয়াবেন না। কোনো কোনো অঞ্চলে কবিরাজি ঝাড়ফুঁক, নাকে নস্যি দেয়া, লতাপাতা খাওয়া নানাবিধ কুসংস্কার দেখা যায়। যেগুলো উপকার করার পরিবর্তে নতুন সমস্যা তৈরি করতে পারে। অতএব, এগুলো থেকে বিরত থাকা জরুরি। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে জন্ডিস না কমলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া দরকার।

সাধারণত হেপাটইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ মারাত্মক কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হেপাটিক ফেইলারের মতো ভয়াবহ পরিণতি আনতে পারে। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের হেপাটিক ফেইলার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যদি জন্ডিসে আক্রান্ত কোনো রোগীর জন্ডিস ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি থাকে, অস্থিরতা দেখা দেয়, অস্বাভাবিক আচরণ করে বা অজ্ঞান হয়ে যায়, তখন বুঝে নিতে হবে যে তার জরুরি অবস্থা এবং কোনো বিলম্ব না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে অথবা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা করার চেয়ে উত্তম হলো হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা। প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায় হলো বিশুদ্ধ ফুটানো পানি পান করা এবং রাস্তাঘাটের খোলা খাবার, পানি, লেবুর শরবত, ফলের রস গ্রহণের অভ্যাস পরিহার করা। এছাড়া হেপাটাইটিস ‘এ’ রোগের টিকা এখন আমাদের দেশে পাওয়া যায়। তাই শিশুদের এই টিকা দিয়ে নেয়া উচিত।

হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’

মূলত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায় এ ভাইরাসদ্বয়। তবে আক্রান্ত মায়ের সংস্পর্শে মা থেকে বাচ্চাতে, একই সিরিঞ্জ বারবার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এবং ঝুঁকিপূর্ণ যৌনমিলনের মাধ্যমেও হেপাটাইটস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস ছড়ায়। এছাড়া আকুপাংচার, মুসলমানী, নাক, কান ফুঁড়ানো, নাপিতের ক্ষুর ইত্যাদি ভাগাভাগি করে ব্যবহার করার মাধ্যমে এরা ছড়াতে পারে। দন্ত চিকিৎসা ও হাসপাতালে অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ঠিকমত অটোক্লেভ, বয়েলিং ইত্যাদি উপায়ে জীবাণুুমুক্ত না করে ব্যবহার করার ফলে ভাইরাসদ্বয় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বহুবার রক্তগ্রহণকারী রোগী, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি, স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথা হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ যেমনÑ ডাক্তার ও নার্স, ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ, দন্তরোগের চিকিৎসকগণ এ ভাইরাসদ্বয়ে আক্রান্ত হওয়ার জন্য অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। সারা বিশ্বে প্রতি ১২ জনে ১ জন লোক হেপাটাইটিস ‘বি’ অথবা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস ‘বি’ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৫ কোটি এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ কোটি। সে হিসাবে এটা অনুমদিত, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫২ কোটি লোক এই ভাইরাস দুটি শরীরে নিয়ে বসবাস করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, অভ্যাস, সামাজিক প্রথা, পরিবেশ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদির ওপরে এ ভাইরাসের উপস্থিতি ভিন্ন রকম। এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বকে মোট তিনভাগে ভাগ করা হয়েছেÑ উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আক্রান্ত এলাকা। বাংলাদেশকে মধ্যম আক্রান্ত এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশের পর এক থেকে ছয় মাস সুপ্তাবস্থায় থাকে। অতঃপর লিভার আক্রমণের বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু ৭৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায় না। ‘সি’ ভাইরাসের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২০ বছরেরও কোনো প্রকার লক্ষণ না-ও দেখা দিতে পারে। সুপ্তাবস্থায় তুষের আগুনের মতো লিভারকে ক্ষয় করতে থাকে; কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুই বুঝতে পারে না। ‘বি’ ভাইরাসের আক্রান্ত ২৫ শতাংশ রোগী হেপাটাইটিসের উপসর্গগুলো নিয়ে হাজির হয়। সাধারণত দুর্বলতা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, ক্ষুধামন্দা, বুকের নিচে ডানদিকে অস্বস্তি, পেটের হজমে গ-গোল, পায়খানার অনিয়ম দেখা দেয়। লক্ষণ প্রকাশ পাক বা না পাক এ সময় ভাইরাসদ্বয় অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়াতে পারে।

আরও পড়ুনঃ   হার্নিয়া অপারেশন

‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস যখন লিভারে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ সৃষ্টি করে, তখন মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তবে এই প্রতিরোধ হেপাটাইটিস ‘এ’ বা ‘ই’-এর হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’কে পুরোপুরি দূর করতে পারে না। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত এই ভাইরাস ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যে যুদ্ধ চলতে থাকে তার প্রভাব পরে লিভারের ওপর। ফলে দুদিক দিয়েই লিভারের কোষ আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। অন্যদিকে আক্রান্ত স্থান যেন অনাক্রান্ত জায়গায় প্রভাব ফেলতে না পারে, তার জন্য ফাইব্রোজেনেসিস নামক বিশেষ প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং আক্রান্ত স্থানগুলোকে তন্তু (ফাইবার) দিয়ে ঘিরে ফেলতে থাকে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে চার থেকে ১০ বছর সময়ে লিভার সিরোসিস হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সিরোসিস থেকে হেপাটিক ফেইলিউর ও লিভার ক্যান্সার নামক মারাত্মক দশায় উপনীত হতে পারে। রোগের ব্যপ্তির ওপর ভিত্তি করে লিভার সিরোসিসকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়। কমপেনসেটেড ও ডিকমপেনসেটেড। কমনপেনসেটেড সিরোসিসের রোগী প্রায় সুস্থ মানুষের মতো কোনো উপসর্গ ছাড়া থাকতে পারেন আবার রক্তবমি বা কালোপায়খানার সমস্যাও হতে পারে। ডিকমপেনসেটেড সিরোসিসে রোগীর শরীরে পানি জমা, জন্ডিস বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হয়। হেপাটিক ফেইলিউর হলে রোগী স্বাভাবিক চেতনা হারায়। ক্যান্সার হলে পেটের ডানদিকে বুকের নিচে শক্ত পি-ের মতো মনে হয়, পেটে অসহনীয় ব্যথা হয়, পেটে-পায়ে পানি আসতে পারে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে আক্রমণ করে বিধায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রাথমিক পর্যায়ে এর কোনো প্রভাব পড়ে না এবং উক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। বিশেষ করে ‘সি’ ভাইরাসের রোগীর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। তবে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় লিভার সিরোসিস হয়ে যাওয়ার পর। কাউকে রক্ত দিতে গিয়ে বা অন্য কোনো অসুস্থতার কারণে রক্ত পরীক্ষা করে শরীরে হেপাইটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’-এর উপস্থিতি আবিষ্কার করা যায়। এসব ক্ষেত্রে ঠিকমতো চিকিৎসা গ্রহণ করলে লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ থেকে লিভার সিরোসিসে রূপান্তরকে প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশ তাদের শরীরের এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসদ্বয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারছে না এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছে না। এ রোগসমূহের বিস্তার ও চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমূহে সার্বজনীন প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষমূলক ব্যবস্থার অভাব, প্রয়োজনীয় ফান্ডের অপ্রতুলতাÑ এ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। সিরোসিস, লিভার ফেইলিউর ও লিভার ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থেকে করতে হয়। বাংলাদেশে লিভার চিকিৎসার সবরকম ওষুধ পাওয়া যায় এবং দেশের অভিজ্ঞ লিভার বিশেষজ্ঞগণ কয়েক দশক ধরে সফলতার সাথেই এই রোগের চিকিৎসা করছেন। ওষুধের মূল্যও ধীরে ধীরে কমে আসছে, তবে এখনও অনেক রোগীর হাতের নাগালের বাইরে। তবে রোগ প্রতিরোধই হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ থেকে মুক্তির সর্বোত্তম উপায়। হেপাটাইটিস ‘বি’-এর টিকা সহজলভ্য এবং দেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। একবার টিকা নিয়ে নিলে এই মারাত্মক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা যায়। বাংলাদেশ সরকার এই টিকাকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা আমাদের জন্য খুশির খবর। কিন্তু হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের কোনো টিকা নেই। এ কারণে এ ভাইরাস প্রতিরোধে ভাইরাসের বিস্তারের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেগুলো থেকে নিরাপদ থাকা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রক্তপরিসঞ্চালনের আগে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’-এর উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও সহায়তা দেয়া হচ্ছে। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ব্লগ, ইন্টারনেটভিত্তিক গণমাধ্যমগুলোর সাহায্যে এ রোগগুলোর বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা অনেক কমে আসবে।

আরও পড়ুনঃ   বিষণ্ণতা প্রতিরোধ

উপসংহার : আলোচ্য প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাল হেপাটাইটিস রোগের কারণ, লক্ষণ, পরিণাম, প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে ধারণা পেলাম। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা নিজেরা সচেতন হব এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবকে অবহিত করে এ রোগগুলো থেকে নিস্তার পেতে সহযোগিতা করব। একই সাথে জন্ডিস হলে যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন পদ্ধতি গ্রহণের রীতি সমাজে প্রচলিত আছে, তা থেকেও মুক্ত হতে চেষ্টা করব।

১ অধ্যাপক মবিন খান

দি লিভার সেন্টার, ঢাকা, বাংলাদেশ, মির্জা গোলাম হাফিজ রোড, বাড়ি নং-৬৪, রোড নং-৮/এ, ধানমন্ডি, ঢাকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × 4 =