প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ মাতৃত্ব

0
1410
প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ,নিরাপদ মাতৃত্ব

প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে প্রজননতন্ত্রে সামগ্রিক সুস্থতা েবাঝায়। একজন গর্ভবতী নারী গর্ভকালীন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য প্রসবের যাবতীয় সেবা এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা পাওয়ার অবশ্যই অধিকার রাখেন। এটা গর্ভবতী নারীর সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। নারীর গর্ভধারণ ও শিশু জন্মদানের প্রক্রিয়া প্রত্যেক মায়ের জন্যই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় স্ত্রীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার জন্য সবার আগে তাঁর স্বামীর সহযোগিতা প্রয়োজন।

একজন মা যদি গর্ভধারণে পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, গর্ভধারণের আগে নিজেকে প্রস্তুত করেন, প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকেন, তাহলে মা ও শিশুর সুস্থতা কোনো জটিল বিষয় হবে না। সন্তান ধারণ বিষয়টিকে নারীর ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে দরিদ্র পরিবারে গর্ভবতীর প্রতি বিশেষ যত্ন ও নিয়মিত চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অনেক অসচ্ছল পরিবারে গর্ভবতী নারী যথাযথ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান না। এভাবে পারিবারিক অসচেতনতা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার নিম্নমুখী মান, ভুল চিকিৎসা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি সর্বোপরি নারীর প্রতি পরিবারের পুরুষের অবহেলার কারণে নারীরা যথাযথ মাতৃস্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ সন্তান গর্ভে আসার মুহূর্ত থেকেই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকলে সুস্থ শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব এবং মাতৃস্বাস্থ্য নিয়েও কোনো চিন্তা করতে হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রোগ ও দাওয়া (ওষুধ) দুটিই পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি রোগেরই ওষুধ পাঠিয়েছেন। সুতরাং তোমরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করো।’ (মিশকাত ও আবু দাউদ)
মায়ের বয়স, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং গর্ভকালীন খাবারের সঙ্গে মা ও শিশুমৃত্যুর হারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। সমাজে গর্ভবতী মায়ের অপরিমিত খাবার একটা সাধারণ ব্যাপার। খাদ্যের বেলায় আর্থিক সংগতি যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী কুসংস্কার অর্থাৎ শিক্ষার অভাব। মাতৃগর্ভে ভ্রূণের যথাযথ পরিপুষ্টি প্রয়োজন। ভ্রূণের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তাও বাড়ে। তাই গর্ভবতী মায়ের সুষম খাদ্য ও পুষ্টিমানের বাড়তি খাবারের দরকার। বিশেষ করে, গর্ভধারণের শেষের তিন-চার মাস থেকে বাড়তি খাবারের প্রয়োজন খুবই বেশি। এ জন্য সুস্থ ও সবল শিশু পেতে হলে গর্ভাবস্থায় মাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য খেতে দিতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেন, ‘সন্তানের বাবার দায়িত্ব হলো মায়ের খাওয়া-পরার উত্তম ব্যবস্থা করা।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৩৩) সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর খাবারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা (স্বামীরা) যা খাবে, তাদের (নারীদের) তা-ই খেতে দেবে।’
গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও ঘন ঘন সন্তান জন্মদানের কারণে মেয়েদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে, ফলে মারাত্মক অসুস্থতার কারণে মাতৃমৃত্যুর মতো বেদনাদায়ক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তাই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। মাতৃমৃত্যু রোধ ও অসুস্থতার হার কমানোর জন্য প্রজনন বয়সী মা এবং জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিবার পরিকল্পান সেবা প্রদানকারীদের যথাযথ যোগাযোগ এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। মানসম্মত প্রজনন স্বাস্থ্য সুঠাম ভাবী প্রজন্ম সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সুঠাম কার্যকর সন্তানসন্ততি উৎপাদন করে উন্নত দেশ-জাতি ও পৃথিবীকে মানুষের বসবাস উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। এ জন্য মুসলিম পরিবারে নারীর গর্ভধারণ থেকে প্রসব-পরবর্তী সময় পর্যন্ত মাকে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা, সৎ পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে একাধিকবার প্রয়োজনীয় মাতৃস্বাস্থ্যসেবা ও ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ ইসলামের বিধান। রাসুলুল্লাহ (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা করো। কারণ যিনি রোগ দিয়েছেন, তিনি তার প্রতিকারের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় প্রসূতিকালীনও নারী শ্রমিকেরা মাতৃকল্যাণ সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। অথচ গর্ভকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, বিশেষ যত্ন, খাদ্য ও পুষ্টি পাওয়া যেকোনো নারীর আইিন অধিকার। মাতৃত্ব অর্জন নারীর স্বাভাবিক জীবনযাপনের অংশ এবং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্বও বটে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও মানবসমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য মাতৃত্ব লাভ জরুরি। তাই কর্মজীবী নারীরা যেন নিরাপদে মাতৃত্ব লাভের সুযোগ পান, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও মালিকসহ সবার; কারণ এটি নারী শ্রমিকের আইিন অধিকার।
প্রকৃতপক্ষে নিরাপদে মা হওয়া প্রত্যেক নারীরই ন্যায়সংগত অধিকার। এর সঙ্গে সভ্য দেশ ও উন্নত জাতি গঠনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাধারণত বাল্যবিবাহ ও গর্ভসঞ্চার, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীর নিরাপদে মা হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। তাই প্রজনন স্বাস্থ্যসচেতনতা, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণ, মাতৃমৃত্যু রোধ করা এবং পরিবার পরিকল্পনাকে গতিশীল করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবায় মসজিদের ইমাম-খতিবদের ভাষণের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে জেগে উঠতে পারে প্রজনন স্বাস্থ্যসচেতনতাবোধ। মূলত জাতি-ধর্ম-দল-মতনির্বিশেষে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং কার্যকর ভূমিকার ফলেই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, জন-উর্বরতা, শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ, গর্ভবিরতিকরণ, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি-সংক্রান্ত জ্ঞান ও যথাযথ ব্যবহার—এসব মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন বিষয়ে সমাজে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুনঃ   চিকিৎসা সম্পর্কে ইসলামী বিধান কী?

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

14 + 4 =