জাতীয় মেধা ও জাতীয় শক্তির ওপরই জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভরশীল, আর এ শক্তি নির্ভরশীল হচ্ছে জাতীয় স্বাস্থ্যের সুস্থতার ওপর। বিশেষ করে সমাজের তারুণ্য দীপ্ত, কর্মচঞ্চল যুবশ্রেণী, যাদের উদ্বেলতা ও দুর্জয় মনোবল দ্বারা জাতির বড় বড় কার্যাবলী সম্পাদিত হয়, সেই যুবশক্তি কোনো কারণে অসুস্থতা ও অক্ষমতার শিকার হয়ে পড়লে সংশ্লিষ্ট জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে বাধ্য। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা হেতু এমনিতেই আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য সামগ্রিকভাবে প্রয়োজনীয় পুষ্টিহীনতার শিকার। অধিকন্তু বিদ্যমান খাদ্য-খাবার ভেজাল মিশ্রিত হওয়ায়, খাবারের লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত। পরন্তু তার সাথে জাতির যুব সমাজের স্বাস্থ্য, মেধা, চরিত্র সকল কিছু ধ্বংসকারী মারাত্মক কুঅভ্যাস যদি তাদের মধ্যে প্রকট হয়ে দেখা দেয়, তাহলে আমাদের যুবশক্তি যে ধীরে ধীরে শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক-চারিত্রিক সকল দিক থেকেই ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলাবাহুল্য, দেশের যুবশক্তির একটি বিরাট অংশ উল্লেখিত ধ্বংসের পথই অনুসরণ করছে।
গত কয়েক দিনের জাতীয় সংবাদপত্রের অনেকগুলোতেই জাতির যুবচরিত্র বিধ্বংসী মাদকাসক্তি ও চারিত্রিক বিকৃতির ভয়াবহ সংবাদদি প্রকাশ হচ্ছে। মাদকাসক্তি এবং যুব সমাজের নৈতিক, শারীরিক ও চারিত্রিক অধঃপতনজনিত খবরা-খবর সংবাদপত্রে নিত্যদিনই প্রকাশিত হয়ে থাকে। সেসব খবরের ওপর ভিত্তি করে আইন-শৃক্মখলা রক্ষা সংস্থার লোকদের মাঝে-মধ্যে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও দেখা যায়। কিন্তু এসব ব্যবস্থার ফলে সাময়িক যৎসামান্য সুফল লক্ষ্য করা গেলেও তার স্থায়ী কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। বরং নতুন নামে, নতুন কৌশল ও নতুন চরিত্রে মাদকাসক্তির আত্মঘাতী প্রবণতা অধিক শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে এ প্রবণতা এবার সমাজ দেহের মাথাই পচিয়ে দিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সমাজের অভিজাত ঘরের আদরের ছেলেমেয়েরা এবং উচ্চ শিক্ষার সাথে জড়িত ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে এই আত্মঘাতী কুঅভ্যাস ও সমাজবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়েছে, জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত খবরাদি থেকেই তা সহজে অনুমেয়। এতদিন যাবত হেরোইন, ফেনসিডিল ইত্যাদি নামের মাদকদ্রব্যের কথা শোনা গেলেও এখন এই লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে আরো মারাত্মক ট্যাবলেট যার নাম হলো ইয়াবা। আন্তর্জাতিক বাজারে ট্যাবলেট, ইনজেকশন এবং পাউডার এই তিন ধরনের ইয়াবা পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে ট্যাবলেট ও পাউডারই ইয়াবা ব্যবহারকারী মাদকসেবীদের অধিক পছন্দ। এই সর্বনাশা ট্যাবলেট বিক্রেতা ও এর আসক্তদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকে অভিজাত এলাকার মেধাবী তরুণ-তরুণীদের এই ট্যাবলেট সেবন করে যৌন সংসর্গসহ নানান অপকর্মে জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর কথা প্রকাশ পেয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, র্যাব ও পুলিশের সাক্ষাতের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে কোটিপতি, শিল্পপতি, রাজনীতিক, মন্ত্রী, আমলা ও রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারক মহলের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার আদরের ছেলেমেয়েদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন, বিক্রয় ও পাইকারী বিক্রেতা হিসেবে সরবরাহ করার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। আসক্ত তরুণ যুবক-যুবতীদের বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়ে এবং কলেজের ছাত্রছাত্রী। বিশেষজ্ঞদের মতে, একবার এই মাদকদ্রব্যে আসক্ত হলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। এই ট্যাবলেট গ্রহণ করলে হার্টবিট এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। এর ফলে মস্তিষ্কের ছোট রক্তনালীগুলোর ক্ষতি হয়, যদ্দরুণ স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। ফলে তাকে এর নির্মম পরিণতি মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়তে হয়। এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে আরো বলেন যে, ক্রমাগত এ ট্যাবলেট ব্যবহার শরীরের নার্ভ সিস্টেমকে ক্রমেই অকেজো করে তোলে। প্রথম দিকে আসক্ত ব্যক্তির কার্যক্ষমতা বাড়লেও কিছু দিন পর তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। তারা আরো বলেন, যারা এ ট্যাবলেট গ্রহণ করে তারা একনাগাড়ে ২/৩ দিন না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু পরে যখন ঘুমায়, সহজে তাদের ঘুম ভাঙ্গে না। তাতে চিরদিনের জন্য ঘুম না ভাঙ্গার ঘটনাও ঘটতে পারে।
মোটকথা, মাদকদ্রব্য এবং সমাজের উঁচু স্তরের ছেলেমেয়েদের এ সংক্রান্ত অপকীর্তি সম্পর্কিত প্রকাশিত খবরাদি এবং এগুলোর শিরোনামের প্রতি তাকালে আমাদের সমাজের নৈতিক, সামাজিক পচনশীলতা ও ধ্বংসের আরেকটি উদ্বেগজনক ভয়াবহ চিত্রই ফুটে ওঠে। সমস্যাটির ধরন, চরিত্র ও তার প্রচার-প্রসারের প্রতি তাকালে দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, আমাদের গোটা জাতিকে যেই শ্রেণীর অসৎ, অসাধু, অযোগ্য ও চরিত্রহীন নেতৃত্ব তাদের অনুসৃত ভ্রান্তনীতির দ্বারা দীর্ঘদিন থেকে বিপথে পরিচালিত করে গোটা দুনিয়ার সামনে একে হেয় করেছে, যুবসমাজের মাদক সংক্রান্ত উল্লেখিত উদ্বেগজনক ভয়াবহ পরিস্থিতিটিও তাদেরই অপকর্মের পুঁতিগন্ধময় আরেকটি অংশ। এ ছাড়া আমাদের জাতীয় সত্তাকে ভিতর থেকে ধ্বংস করার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে এখানে অপসংস্কৃতির যেই ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে, সেই ষড়যন্ত্রের সাথেও এর সম্পৃক্ততা অসম্ভব নয়।
নিজ ভবিষ্যৎ বংশধর যাতে মানবীয় গুণাবলী সমৃদ্ধ হয়ে উন্নত চরিত্র, মননশীলতা ও যথার্থ জীবনবোধ ও জীবনাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে, এ জন্য বিশ্ব মানবতার সর্বশেষ খোদায়ী শিক্ষক মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ) এ কারণেই ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রশিক্ষণের বিরাট দায়িত্ব তাদের জনক-জননী, মাতা-পিতা ও সামাজিক রাষ্ট্রিক নেতৃত্বের ওপর অর্পণ করেছেন। খোদ মহাস্রষ্টা, আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, শেষ বিচারের দিন আল্লাহর দরবারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিরা এই বলে তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক অভিভাবকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে যে, ‘‘হে আমাদের প্রভু! আমরা (বস্তু জীবনে) আমাদের মুরুববী, অভিভাবক ও নেতৃবৃন্দের নীতি অনুসারে চলেছি। তারা আমাদেরকে আপনার (মনোনীত) পথের বদলে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। সুতরাং তাদেরকে এ জন্যে দ্বিগুণ শাস্তি দিন।’’
এদিক থেকে আমাদের দেশ-জাতি-সমাজের বর্তমান বহুমুখী দুরবস্থার জন্য যে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নেতৃত্ব বহুলাংশে দায়ী, তা অস্বীকারের উপায় নেই। কাজেই এ সকল স্তরের নেতৃত্বের কর্তব্য হলো- জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাসহ জাতীয় জীবনের সকল বিভাগে বিরাজমান যেসব কারণে আজ জাতি নৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, চারিত্রিক সকল দিক থেকে মহাক্ষতির সম্মুখীন, এ সকল ক্ষেত্রের সংস্কারের কাজে সকলকে ঐক্যবদ্ধ ও আপোসহীনভাবে এগিয়ে আসা। অন্যথায় শেষ বিচারের দিনের উল্লেখিত অভিযোগ স্খলন ও জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত থাকুন।