জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে নিরাপদ মাতৃত্বের কথা বলা হলেও গ্রাম বাংলার তৃণমূল পর্যায় থেকে অগ্রসর শহর পর্যন্ত নিরাপদ মাতৃত্বের নিশ্চিত ব্যবস্থা হয়নি। মাতৃসেবার মান ও সুযোগের সীমাবদ্ধতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রতুলতার সাথে রয়েছে অবহেলা এবং মাতৃত্ব সেবার নামে কসাইবৃত্তি। এক সময় ছিল, যখন মায়েদের প্রসবকালে গ্রাম্য ধাত্রীদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়া গ্রাম্য ধাত্রীরা তাদের অভিজ্ঞতায় নবজাতককে প্রসব করাতেন। তবে এখন আগের মতো অভিজ্ঞ ও নির্ভরশীল গ্রাম্য ধাত্রীদের সংখ্যাও কমে গেছে। থানা-উপজেলা, জেলা থেকে শুরু করে বড় বড় হাসপাতালেও প্রসূতি বিভাগের সুযোগ-সুবিধা সীমিত। যাও আছে, সেসব জায়গায় ডাক্তার-নার্সরা স্বাভাবিক ডেলিভারির বদলে সিজারিয়ান করে প্রসব ঘটিয়ে কসাইয়ের দিকেই বেশি আগ্রহ দেখায়। এতে একদিকে গর্ভবতী ও তার পরিবারের আর্থিক ঝুঁকি ছাড়াও শারীরিক ঝুঁকিও বহন করতে হচ্ছে। অথচ মাতৃসেবার মান বৃদ্ধি ও সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয়া তেমন কঠিন কাজ নয়। প্রতিষ্ঠিত সরকারি-বেসরকারি বা প্রাইভেট মাতৃসদনগুলো ছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগ ইচ্ছা করলে প্রতিটি গ্রামে বা ই্্উনিয়নে ৪/৫ জন প্রশিক্ষিত ধাত্রীর ব্যবস্থা করতে পারে। গ্রাজুয়েট নার্স ছাড়াও শিক্ষিত বেকার গ্রাম্য নারীদের শর্ট কোর্স ট্রেনিং দিয়ে প্রশিক্ষিত ধাত্রী তৈরি করা কোনো কঠিন কাজ নয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, স্বাস্থ্য বিভাগের স্থানীয় ইউনিটসমূহের অবকাঠামো ও তদারকি ব্যবহার করা যায়।
আমাদের দেশে প্রতি বছর ১২ হাজার নারীর মৃত্যু ঘটে প্রসবকালীন জটিলতার কারণে। আর এসব মায়ের জন্ম দেয়া শিশুদের প্রতি চারজনের তিনজনই মারা যায় জন্মের পঞ্চম সপ্তাহের মধ্যে। এছাড়া দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩ দশমিক এক এবং শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৬৫। উন্নত বিশ্বের তুলনায় এ হার খুবই উদ্বেগজনক।
যে কোনো সভ্য সমাজেই প্রজন্ম সেবা পাওয়া একজন নারীর মানবিক ও জাতীয় অধিকার। তবে সার্বিক বিবেচনায় এটাকে মানব সমাজের ভিত্তি ধরা যায়। নারীর প্রজন্ম স্বাস্থ্য নিশ্চিত না হলে মানবতাই অরক্ষিত থাকে। মায়েদের গর্ভকালীন পুষ্টি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দান, প্রসবের সময় দক্ষ ধাত্রীর ব্যবস্থা করা এবং প্রসব পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করা। এ দায়িত্ব নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সমাজের যৌথ দায়িত্ব। তবে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রে যেখানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়ে থাকে, তাতে স্বাস্থ্যসেবাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা। এর জন্য গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেন না একজন মা জাতির ভবিষ্যৎ ধারণ ও বহন করেন। অসুস্থ মায়ের শিশু কখনও সুস্থ হয় না। সুস্থ শিশু মানে সুস্থ ও সবল জাতি। সংগত কারণে গর্ভবতী মায়েদের গোটা জাতির স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বিন্যাস করতে হবে।
এক পরিসংখানে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি মিনিটে একজন করে গর্ভবতী নারীর মৃত্যু হয়্ প্রসবের পর। মায়ের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ, খিঁচুনি ইত্যাদি। আর এসবের মূল কারণ হচ্ছে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে প্রসব করানো, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পেতে বিলম্ব, পুষ্টির অভাব ইত্যাদি।
প্রথমত গ্রামে বা শহরে যেসব অদক্ষ ধাত্রী রয়েছেন, তাদেরকে দক্ষ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সাথে দক্ষ নার্স ও ধাত্রীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাতৃসদন বাড়াতে হবে।
ফাতিমা সাঈজউদ্দীন