ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাস্থ্য সচেতনতা

0
676

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব: মানবজীবনের অন্যতম নেয়ামত স্বাস্থ্য। এটি এমন এক সম্পদ যা আমাদের ব্যবহারিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এমনকি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যও জরুরি। ইসলামের বিধিবিধানগুলো সুন্দরভাবে পালন করার জন্যও স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা প্রয়োজন। কারণ শারীরিক শক্তি ও মানসিক মনোবল ছাড়া ইবাদতেও মন বসে না

মানবজীবনের অন্যতম নেয়ামত স্বাস্থ্য। এটি এমন এক সম্পদ যা আমাদের ব্যবহারিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এমনকি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যও জরুরি। ইসলামের বিধিবিধানগুলো সুন্দরভাবে পালন করার জন্য ও স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা প্রয়োজন। কারণ শারীরিক শক্তি ও মানসিক মনোবল ছাড়া ইবাদতেও মন বসে না। তা ছাড়া আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার জন্য শক্তি ও স্বাস্থ্য প্রয়োজন। তাই সুস্থ সবল মুমিন আল্লাহর কাছে অবশ্যই অধিক প্রিয়। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘দুর্বল মুমিনের তুলনায় শক্তিশালী মুমিন অধিক কল্যাণকর ও আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে’। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৯৪৫)
অন্য হাদিসে আছে, ‘দুটি নেয়ামতের বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ অসতর্ক ও প্রতারিত।
সুস্থতা ও অবসর।’ (বুখারি শরিফ ৫/২৩৫৭)
ইসলামের দৃষ্টিতে, ‘অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার চেয়ে সুস্থ অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম।’ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ‘আল বিকায়াতু খাইরুম মিনাল ইলাজ’। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞান ইসলামের সেই থিউরি স্বীকার করে ঘোষণা করে, ‘রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে উত্তম।’ বর্তমানে এ কথাও বলা হয় যে, ‘রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে সস্তা।’ আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এই যুগে বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করছে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা: আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে তা বলে দিয়ে গেছেন। তিনি ঘোষণা করে গেছেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দাকে নেয়ামত সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো তার সুস্থতা সম্পর্কে। তাকে বলা হবে আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি?’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৩৫৮)
চিকিৎসা নেয়ার গুরুত্ব :

রোগাক্রান্ত হলে অনতিবিলম্বে চিকিৎসা নেয়া ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে জরুরি। চিকিৎসা নেয়াকে তাকওয়া পরিপন্থী মনে না করে আরোগ্য লাভের জন্য চিকিৎসা নেয়ার জন্য রোগীকে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। রাসূলুল্লাহ সা: নিজে অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতেন। লোকদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা নাও, কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে যার কোনো প্রতিষেধক নেই, তাহলো বার্ধক্য।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৮৫৭)
অন্য হাদিসে আছে, হজরত আনাস ইবনে মালেক রা:-কে শিঙ্গা দান কারীর শিঙ্গার বিনিময় উপার্জন হালাল কি না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: শিঙ্গা নিতেন। আবু তায়বাহ তাকে শিঙ্গা লাগান। রাসূলে কারিম সা: তাকে দুই সা (একটি নির্দিষ্ট ওজনের নাম) খাদ্যদ্রব্য দেয়ার নির্দেশ দেন। এবং তার মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করে তার ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে দেন। আর বলেন, ‘যা কিছু দ্বারা তোমরা চিকিৎসা কর তার মধ্যে উত্তম হলো শিঙ্গা লাগানো।’ (মুসলিম শরিফ, ২/২২ হাদিস নং ৪০০৭) আরেকটি হাদিসে আছে, হজরত সা’দ (রা:) বলেন, ‘আমি একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে দেখতে এসে তাঁর হাত মোবারক আমার বুকের ওপর রাখেন। আমি অন্তরে এর শীতলতা অনুভব করি। অতঃপর তিনি বলেন, তুমি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছ। তুমি ছাকীফ গোত্রের হারেস ইবনে কালদার কাছে যাও। সে (এই রোগের) চিকিৎসা করে।’ (আবু দাউদ হাদিস ২/৫৪১, হাদিস নং ৩৮৬৯, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১৪৪-১৪৫ হাদিস নং ৮৩০০)
রাসূল সা: অসুস্থ ব্যক্তিকে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করাতে এবং এ ব্যাপারে সবিশেষ সতর্ক থাকতে নিদের্শ দিতেন। (যাদুল মাআদ) হারাম বস্তু ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রোগও নাজিল করেছেন রোগের প্রতিষেধকও নাজিল করেছেন। প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা রয়েছে।
সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর। তবে হারাম বস্তু দ্বারা চিকিৎসা নিয়ো না।’ তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘হারাম বস্তুতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য আরোগ্য বা রোগমুক্তি রাখেননি।’ (যাদুল মাআদ) এই সব হাদিস দ্বারা বুঝা যায় ইসলামের দৃষ্টিতে চিকিৎসা গ্রহণ করা শুধু বৈধই নয় বরং তা গ্রহণ করাই কাম্য।
সুস্থ থাকার ইসলাম নির্দেশিত উপায় :

আরও পড়ুনঃ   হস্তমৈথুন থেকে মুক্তি লাভের উপায় : শেষ পর্ব

যেসব কারণে মানুষ অসুস্থ হতে পারে ইসলামি শরিয়ত সেসব থেকে বেঁচে থাকার জোর তাগিদ দিয়েছে। তাই ইসলামি শরিয়ত কতৃর্ক নির্দেশিত স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলা ও অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেয়া প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জরুরি।
১. খাদ্য পানীয় মানুষের রোগব্যাধির অন্যতম কারণ। হাদিস শরিফে আছে, ‘পেট সব রোগের কেন্দ্রস্থল’। ইসলাম এ বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং অতিভোজন করতে নিরুৎসাহিত করেছে। সাথে সাথে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কুরআনে আছে, ‘তোমরা খাও ও পান কর এবং অপচয় কর না। নিশ্চয়
তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ : ৩১) হাদিস শরিফে আছে, রাসূলে কারিম সা: বলেছেন, ‘পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য দিয়ে, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে’ (সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস নং ৩৩৪৯) রাসূল সা: কখনো পেটপুরে খেতেন না। পরিমিত খাবার গ্রহণে
অভ্যস্থ হলে সব ধরনের রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়।
২. খাদ্যদ্রব্য সর্বদা ঢেকে রাখা ও কিছু পান করার সময় তাতে ফুঁ দেয়া নিষেধ করা হয়েছে। কারণ এতে রোগব্যাধি সৃষ্টি হতে পারে। অন্য হাদিসে আছে, ‘খবরদার! তোমরা পানিতে ফুঁ দিয়ো না’। (তিরমিজি শরিফ )
৩. খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধৌত করার প্রতি ইসলামের নির্দেশ রয়েছে। কারণ হাতে বিষাক্ত জীবাণু থাকায় রোগ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৪. শরীর সবল ও সতেজ রাখার জন্য শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা, ব্যায়াম ও সাঁতার কাটা প্রভৃতির প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম ও বিশ্রাম সুস্বাস্থ্যের জন্য অতীব জরুরি। ইসলামে অলসতাকে অত্যন্ত ঘৃণা করা হয়েছে। হাদিস শরিফে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি উৎকণ্ঠা থেকে, মনোকষ্ট থেকে, অলসতা থেকে, কাপুরুষতা থেকে, কৃপণতা থেকে, ঋণগ্রস্থতা থেকে এবং মানুষের
কর্তৃত্বাধীন হয়ে যাওয়া থেকে।’ (বুখারি শরিফ ৩/১০৫৯)
৫. দৈহিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও জরুরি। বরং মানসিক সুস্থতা দৈহিক সুস্থতার পূর্বশর্ত। কারণ মানসিক প্রশান্তি ও উৎফুল্লতা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মানসিক উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা দেহের রোগ প্রতিরোধ কমিয়ে ফেলে। তাই ইসলাম মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রেখে বৈবাহিক জীবন ব্যবস্থার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়েছে।
তাছাড়া ইসলামের ইবাদত ব্যবস্থা ও জিকির-আজকারের দ্বারাও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জেনে রাখ! আল্লাহ তায়ালার জিকির দ্বারা অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’ (সূরা রাদ : ২৮)
৬. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা ও ঈমানের অঙ্গ। পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ পরিবেশ দূষণের কারণে মানব সমাজে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়। হাদিস শরিফে আছে, রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেন,‘তোমরা তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনা সব দিকে পরিষ্কার রাখবে। ইহুদিদের অনুকরণ কর না। তারা বাড়িতে আবর্জনা জমা করে রাখে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২৭৯৯)
তাছাড়া কেউ যদি মেসওয়াক, অজু, গোসল, পোশাক-আশাক প্রভৃতির ক্ষেত্রে ইসলামি নির্দেশনা মেনে চলে তাহলে সে অপরিচ্ছন্নতা জনিত রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে।
৭. যত্র তত্র মলমূত্র ত্যাগ করা নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তাতে রোগব্যাধির ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। হাদিস শরিফে আছে, রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তিন অভিশপ্ত ব্যক্তি থেকে বেঁচে থাক, যে পানির ঘাটে, রাস্তার ওপর ও গাছের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করে’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২৬)
মোটকথা, মানবতার কল্যাণ ও সফলতার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার ইসলাম সেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাই কেউ যদি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে ইসলামের নিদের্শনা মেনে চলে তাহলে সে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারবে। এতে সে দুনিয়া আখিরাতে কামিয়াব হতে পারবে।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া রহমানিয়া সওতুল হেরা, টঙ্গী, গাজীপুর

আরও পড়ুনঃ   স্বাস্থ্য পরিচর্যাঃ ইসলামের দিকনির্দেশনা

ইসলামে স্বাস্থ্য সচেতনতার তাগিদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × 5 =