বিবাহের পর একটি সুখী এবং সমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবন গঠনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান ভূমিকা থাকে। আর এটা সব সময় এক রকম থাকে না। কখনো কমে কখনো বাড়ে। আমাদের দেশের একটি গ্রাম্য প্রবাদ রয়েছে -“সংসার সুখী হয় রমনীর গুনে।” এর থেকেই বুঝা যায় কখনো কখনো একটি পরিবারে স্ত্রীর ভুমিকাও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায়। কিন্তু সুখী দাম্পত্য জীবন গঠনে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই রয়েছে কিছু সতন্ত্র ভুমিকা।
আমাদের এটা জানা উচিত, যে কোন ব্যক্তির আত্মনির্মাণের জন্যে সুখী ও অনুকূল পারিবারিক পটভূমি সবচেয়ে বেশি সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। অনুকূল পারিবারিক পরিমণ্ডল ব্যক্তিত্ব ও মেধা বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। পরিবার গড়ে ওঠে একজন নারী ও একজন পুরুষের পারিবারিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। এই সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হবে, যত মমতা ও শ্রদ্ধামাখা হবে, পারিবারিক আচার আচরণ যত প্রো-অ্যাকটিভ, সুশৃঙ্খল ও সুপরিকল্পিত হবে, ততই পারিবারিক পরিমণ্ডল মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি সুখী পরিবার ও অনুকূল পারিবারিক পরিমণ্ডলের ভিত্তি হচ্ছে ভালবাসা ও মমতা, শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা ও আত্মিক একাত্মতা। অনুকূল পারিবারিক পরিমণ্ডলে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক পরস্পরের পরিপূরক। পারিবারিক পরিমণ্ডলে এই পরিপূরক একাত্মতাই ব্যক্তির আত্মনির্মাণ ও মেধার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পারিবারিক জীবনে পরিপূরক একাত্মতা সৃষ্টির জন্যে পারস্পরিক ভালবাসা, মমতা বৃদ্ধির এবং সুশৃঙ্খলতা সৃষ্টির জন্যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কিছু নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। এই নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে পারিবারিক জীবন সুশৃঙ্খল ও মমতাপূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যক্তিত্ব ও মেধার বিকাশ সহজ হবে। সফল ও সুখী পরিবার গঠনের জন্যে পুরুষ ও নারী উভয়ের করণীয় হচ্ছে :
ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে করণীয় :-
- স্রষ্টার ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখা।
- নিয়মিত ইবাদত/উপাসনা করা।
- দায়িত্বশীল ও আত্মবিশ্বাসী হওয়া।
- আত্ম উন্নয়নের লক্ষ্যে নিয়মিত পড়াশোনা করা।
- সবসময় আশাবাদী হওয়া ও শোকর গোজার করা।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকা।
- সব ব্যাপারে সময় ও নিয়মানুবর্তী হওয়া।
- আগে থেকে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা।
- শালীন ও মার্জিত পোশাক পরিধান করা।
- পরচর্চা ও গীবত বর্জন করা।
- মিথ্যা বর্জনে সচেষ্ট থাকা।
- নিয়মিত আত্মপর্যালোচনা করা।
ব্যক্তি আচরণের ক্ষেত্রে করণীয় :-
- সবসময় হাসিমুখে কথা বলা।
- সবসময় প্রো-অ্যাকটিভ থাকা।
- কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা।
- রাগ ও ক্রোধের বশে কোন কাজ না করা।
- বিতর্ক ও ঝগড়া কৌশলে পরিহার করা।
- কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেয়া।
- কাউকে ঠকানোর চেষ্টা না করা।
- কারও প্রতি ঈর্ষা পোষণ না করা।
- স্বজ্ঞানে অন্যের ক্ষতি সাধন না করা।
- সেন্টিমেন্ট ও আবেগ প্রকাশে কুশলী হওয়া।
- নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা।
- কর্মচারী ও গৃহকর্মীর সাথে মানবিক আচরণ করা।
পারিবারিক জীবনে ক্ষেত্রে করণীয় :-
- স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে বুঝতে চেষ্টা করা।
- অন্যের কথায় কান না দেয়া।
- ভুল বোঝাবুঝি নিজেরাই আলাপ আলোচনা করে দূর করা। তৃতীয় কাউকে এতে না জড়ানো।
- ঘরের কথা বাইরে না বলা।
- পরস্পরের জন্যে নিয়মিত দোয়া করা।
- পরিবারে অশান্তি ও কলহ সৃষ্টি হতে পারে এমন কথা না বলা।
- একান্নবর্তী পরিবার হলে সবার সন্তানকেই এক নজরে দেখা। সবার জন্যে একই মানের কেনাকাটা করা।
- ভ্রমণ, বিনোদনের ব্যাপারে পরিবারের বেশির ভাগের মত অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়া। সবাইকে নিয়ে বেড়ানো।
- পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিয়মিত আত্ম উন্নয়নমূলক আলোচনার আয়োজন করা।
- সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু সম্পর্ক বর্জন।
- দাম্পত্য জীবনে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে এমন সম্পর্ক বর্জন করা।
- গৃহকর্মীদেরকে নিজেদের সমমানের খাবার প্রদান করা।
- পারিবারিক পরিবেশকে ধূমপান ও নেশামুক্ত এলাকায় পরিণত করা।
পরিবারে স্ত্রী হিসেবে করণীয় :-
- সংসারের প্রতিটি কাজকে ইবাদত মনে করা।
- নিজেকে পরিবারের প্রাণ মনে করা।
- স্বামীকে বন্ধু, জীবনসঙ্গী, দিশারী ও পারিবারিক প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা।
- স্বামীকে লুকিয়ে কোন কাজ না করা।
- স্বামীর ভাল কাজ, অবদান ও কৃতিত্বের জন্যে গর্ববোধ করা।
- স্বামীর প্রতি সর্বাবস্থায় বিশ্বস্ত থাকা এবং ভালবাসা ও অনুরাগ কথা ও আচরণে প্রকাশ করা।
- স্বামী-সন্তান বাইরে থেকে আসার সাথে সাথে কোন সমস্যা বা অভিযোগ না করা।
- কোন ভুল বা অন্যায় হয়ে গেলে নিঃসঙ্কোচে তা স্বীকার করা বা স্বামীর কাছে মাফ চেয়ে নেয়া।
- নিজের হাত খরচা থেকে কখনও কখনও স্বামীর জন্যে ছোটখাট উপহার কেনা।
- প্রয়োজনে নিজের অর্জিত অর্থ স্বামী ও সংসারের জন্যে খরচ করা।
- স্বামীর কাছে কোন অযৌক্তিক আবদার না করা।
- স্বামীর যুক্তিসঙ্গত আয় সম্পর্কে ধারণা রাখা। আয়ের মধ্যেই সংসারের খরচ সীমিত রাখা।
- অতিরিক্ত খরচ ও চাপ সৃষ্টি করে স্বামীকে দুর্নীতিপরায়ণ হতে বাধ্য না করা।
- যে কোন বিপদে বা সংকটে স্বামীর পাশে অটল পাহাড়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা।
- স্বামীর অগোচরে কাউকে কিছু না দেয়া।
- স্বামীর আত্মীয়-স্বজন নিয়ে খোঁটা না দেয়া।
- শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে নিজের বাবা-মায়ের মত শ্রদ্ধা করা।
- ঘরের খুঁটিনাটি সমস্যা নিজেই সমাধানে সচেষ্ট থাকা।
- সন্তানের সামনে স্বামীর সাথে ঝগড়া না করা এবং তার ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা না করা।
- চাকরিজীবী হলেও সন্তান ও সংসারের ব্যাপারে যাতে কোন অবহেলা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।
- স্বামীর যে কোন অক্ষমতাকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করা।
- আত্ম উন্নয়ন ও আত্মিক উন্নয়নের কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করা।
- অন্যের কাছে স্বামীকে ছোট না করা।
- মা হিসেবে সন্তানের মাঝে মহৎ মানুষের গুণাবলীকে বিকশিত করার চেষ্টা করা।
- গ্যাসের চুলা প্রয়োজনের বাইরে সবসময় বন্ধ রাখা।
- সকল ধরনের অপচয়ের বিরুদ্ধে পরিবারের সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
- অভিমান না করা। নিজের কষ্টকে বড় করে না দেখা।
- ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখা।
পরিবারে স্বামী হিসেবে করণীয় :-
- স্বামী হিসেবে নিজেকে পরিবারের প্রধান দায়িত্বশীল মনে করা।
- পরিবারের দায়িত্ব পালনকে ইবাদত মনে করা।
- স্ত্রীকে বান্ধবী, জীবনসঙ্গিনী ও ঘরের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা।
- পারিবারিক প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করা।
- স্ত্রীর ভাল কাজ, অবদান ও কৃতিত্বের প্রশংসা করা।
- স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা এবং ভালবাসা ও অনুরাগ, কথা ও আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
- কর্মস্থলের বা বাইরের রাগ, ক্ষোভ ঘরের স্ত্রী-সন্তান বা গৃহকর্মীর উপর প্রকাশ না করা।
- নিজের ভুল নিঃসঙ্কোচে স্ত্রীর নিকট স্বীকার করা। অন্যায় করলে মাফ চেয়ে নেয়া।
- আয় অনুসারে স্ত্রীর প্রয়োজন পূরণ, ছোটখাট উপহার দান ও হাতখরচা প্রদান করা এবং হাতখরচা ব্যয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস না করা।
- স্ত্রীর অর্জিত অর্থ ও সম্পদ ব্যয়ে স্ত্রীকে স্বাধীনতা প্রদান।
- স্ত্রীর যুক্তি সঙ্গত আবদার পূরণ করা।
- নিজেরে আয় সম্পর্কে প্রথম থেকেই স্ত্রীকে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া ও অবৈধ পন্থায় অর্থোপার্জন না করা।
- পেশাগত বা পারিবারিক সংকট দেখা দিলে স্ত্রীর সাথে তা খোলামেলা আলোচনা করা।
- আত্মীয়-স্বজনকে উপহার বা সাহায্য করার ব্যাপারে স্ত্রীকে অযৌক্তিক বাধা না দেয়া।
- স্ত্রীর আত্মীয়দের নিয়ে তাকে কথা না শোনানো।
- স্ত্রীর মা-বাবাকে নিজের মা-বাবার মত শ্রদ্ধা করা।
- ঘরের খুঁটিনাটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা। ঘরের কাজে সাধ্যমত সাহায্য করা।
- স্ত্রীর ভুল-ত্রুটি নিয়ে সন্তানদের সামনে ভর্ৎসনা না করা।
- সপ্তাহে একদিন পুরোপুরি স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে কাটানো।
- ঘরের প্রতিটি কাজ এমনি রান্নাবান্নায়ও পিকনিকের মতো অংশ নেয়া।
- স্ত্রীর যে কোন ভুল-ত্রুটিকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করা।
- অন্যের কাছে স্ত্রীর বদনাম না করা।
- পেশাগত দক্ষতা অর্জনে সদা সচেষ্ট থাকা।
- অর্থ অপচয় না করা। আবেগ প্রসূত কেনাকাটা না করা।
- নিজের দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা।
- স্ত্রীর শারীরিক খোঁজখবর নিয়মিত জিজ্ঞেস করা। অসুস্থ হলে নিজে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া।
- স্ত্রীর যে কোন অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শোনা। কোন প্রস্তাব বা কথায় প্রথমেই না বলা থেকে বিরত থাকা।
- বাইরে কাজ আছে বলে ক্লাব বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তাস খেলে বা ফালতু আড্ডায় সময় নষ্ট না করে পরিবারের আত্মিক ও মানসিক উন্নতির জন্যে সময় ব্যয় করা।
সন্তান পালনে স্বামী-স্ত্রীর করণীয় :-
- ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকল সন্তানকে সমান দৃষ্টিতে দেখা।
- সন্তানকে নেতিবাচক কথা বলে তিরস্কার না করা। সন্তানকে রাগের মাথায় অভিশাপ না দেয়া।
- সন্তানকে ছোট থেকেই সাবলম্বী করে গড়ে তোলা।
- সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া। সন্তান একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের বন্ধু-বান্ধবদের ব্যাপারে সজাগ থাকা। সন্তানের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করা যাতে সন্তান মানসিকভাবে বাবা-মার সাথে একাত্মতা অনুভব করে। সন্তানের সামনে আদর্শ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করা।
- সন্তানকে সবসময় আদেশ না করে তার করণীয় কাজ যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া।
- সন্তান কোন কিছু চাওয়ার সাথে সাথেই তাকে না দেয়া। সন্তানের অন্যায় আবদার পূরণ না করা।
- সন্তানের বয়স ১৮ বছর হলে পারিবারিক পরামর্শে তাকেও অংশীদার করা।
- সন্তান বিনোদনের নামে অপসংস্কৃতির শিকার হচ্ছে কিনা সে দিকে লক্ষ্য রাখা।
- সন্তানকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগে দক্ষ মানুষ রূপে গড়ে উঠতে সাহায্য করা।
- সন্তানের নৈতিক, মানসিক, আত্মিক, সৃজনশীল গুণাবলী বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা।
- চাকরির পরিবর্তে সন্তানকে স্বাধীন পেশা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।
- সন্তানকে আগে সালাম প্রদানে ও হাত মিলানোয় অভ্যস্ত করে তোলা।
- সন্তানের সামনে পরিবারের যথাযথ আর্থিক ধারণা প্রদান করা। আর্থিক ব্যাপারে কোন মিথ্যা না বলা।
স্বামী-স্ত্রীর মধুর দাম্পত্য জীবনে আছে সুখ-দুঃখ আর হাসি-কান্না। আবার এ মধুর জীবনে রয়েছে মনোমালিন্য। তবে মনোমালিন্যতার সময়টুকু যদি দীর্ঘ হয় তাহলে দাম্পত্য জীবনে অসুখী হতে পারেন। তাই এক্ষেত্রে মানবীয় অসৎ গুনাবলীগুলো বর্জন করে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পরিবারের নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে সুখী পারিবারিক পরিমণ্ডল খুব সহজেই গড়ে তুলতে পারেন। (তথ্যসুত্র : কোয়ান্টাম মেথড )
বিঃ দ্রঃ গুরুত্বপূর্ণ হেলথ নিউজ ,টিপস ,তথ্য এবং মজার মজার রেসিপি নিয়মিত আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে লাইক দিন আমাদের ফ্যান পেজ বিডি হেলথ নিউজ এ ।