শ্বাসকষ্ট ও প্রতিকার

0
1091
শ্বাসকষ্ট

বিভিন্ন ধরনের এলার্জেন যেমন-ধূলা বালি-ধোঁয়া, ফুলের রেণু, কলকারখানার নির্গত বিষাক্ত গ্যাস, গাড়ীর ধোঁয়া, বিশেষ কিছু খাবার, ওষুধ ইত্যাদি এলার্জি ও এজমার সৃষ্টি করে। যে কোন সুস্থ ব্যক্তির এলার্জি হতে পারে। সামান্য উপসর্গ হতে শুরু করে মারাত্মক উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে, এমন কি হঠাৎ তীব্র আকারে আক্রমণ করতে পারে। নিউইয়র্কে গবেষকরা বলেছেন যে, যানবাহন রাজপথে হাঁচি উদ্রেককারী এলার্জেন সৃষ্টি করে। ক্যালিফোর্নিয়া ইনষ্টিটিউট অব টেকনোলজির মতে, প্রস্তর ফলক, ইষ্টক প্রভৃতি দ্বারা আস্তর করার পথে বিভিন্ন উৎস হতে কমপক্ষে ২০টি এলার্জেন পাওয়া যায়। ফুটপাতের ধূলিকণাকে বর্ণনা করেন এভাবে যে, এগুলো হচ্ছে মৃত্তিকার ধূলা, গাড়ীর গচ্ছিত নিঃশোষিত পদার্থ, টায়ারের ধূলা, গাছ পাতার খন্ড এবং অন্যান্য যৌগিক পদার্থের জটিল সংমিশ্রণ। পথের ধূলা শহরবাসীদের এলার্জি/এজমাতে প্রবলভাবে গ্রহণ করে। কারণ রাজপথ দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন, লোকজন প্রভৃতির মাধ্যমে এগুলো দ্রুত বেগে বায়ু মন্ডলে মিশে যায়। তাদের মতে শতকরা ১২ ভাগ শহরবাসী নিঃশ্বাসের সঙ্গে এমন বায়ু বাহিত এলার্জেন সৃষ্টি করে।

গবেষকদের মতে, রাজপথের খুব নিকটতম বসবাসকারীদের পথের ধূলার সাথে সম্পর্কযুক্ত এলার্জি ও এজমার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী এবং রাস্তার ১০০ মিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে কাশি, হুইজ, রানিংনোজ এবং নির্ণীত এজমার প্রকোপ অধিক। এজমা এবং এলার্জি নিঃসন্দেহে একটি যন্ত্রনাদায়ক স্বাস্থ্য সমস্যা, তাই এলার্জি ও এজমা যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। এলার্জির সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। কি কারণে এবং কোন কোন খাবারে আপনার এলার্জি দেখা দেয় তা সনাক্ত করে পরিহার করে এলার্জি হতে রেহাই পাওয়া সম্ভব। এলার্জি সৃষ্টি হয় তখন, যখন হিমোনোগ্লোবিন-ই এর পরিমাণ রক্তে বেড়ে যায়। যার ফলে এলার্জেন এন্টিবডির বিক্রিয়ার পরিমাণ বেশী হয় এবং এই বিক্রিয়ার ফলে নিঃসৃত হিস্টামিনের পরিমাণ বেশী হয় যা এলার্জি সৃষ্টি করে। মোট কথা ধূলাবালি, ধোঁয়া, গাড়ীর বিষাক্ত গ্যাস, কলকারখানার সৃষ্ট পদার্থ, বৃষ্টিতে ভেজা, শীতের কুয়াশা, ফুলের রেণু, বিশেষ কয়েকটি খাবার যেমন-চিংড়ি, ইলিশ, বোয়াল, গজার, গরুর মাংস, হাঁসের ডিম, পাকা কলা, আনারস, নারিকেল, কসমেটিকস ও অগনিত জানা-অজানা জিনিস আমাদের শরীরে কাশি, শ্বাকষ্ট এলাজি ও এজমার সৃষ্টি করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ   থ্যালাসেমিয়া কী? থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা কী?

এজমা বা হাঁপানি:দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ এবং তার প্রতি সংবেদনশীলতাই এজমা বা হাঁপানি। এর উপসর্গ হিসাবে দেখা দেয় হাঁচি, কাশি, বুকে চাপা ভাব, শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণে বাধা।

হাঁপানির কারণ:বংশগত এবং পরিবেশগত কারণে হাঁপানি হলেও এ দুটি উৎপাদক কিভাবে সৃষ্টি করে তা পরিষ্কারভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রদাহের কারণে শ্বাসনালী লাল হয়, ফুলে যায়, সরু হয় এবং ইরিটেন্ট বা উদ্দীপক এর প্রতি অতি সংবেদনশীল হয় যার ফলে হাঁপানির উপসর্গ সমূহ দেখা যায়। নিম্নবর্ণিত বিভিন্ন উৎপাদকের কারণে হাঁপানির উপসর্গসমূহ সাধারণত: দেখা যায়।

হাঁপানি উপসর্গের উৎপাদক (ট্রিগার) সমূহ:

>>ইনফেকশন, সাধারণত ভাইরাস জনিত উপসর্গ-যেমন: কোল্ড, ফ্লু ইত্যাদি
>> এলার্জেন, বিশেষত ধূলাবালী, পরাগরেণু, গৃহপালিত পশুপাখির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ ইত্যাদি
>> ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম, বিশেষত শীতকালে আবেগ-যেমন: উত্তেজনা, ভয়, রাগ
>> ইরিটেন্ট, প্রধানত বায়ু দূষণ
>> ধূমপান-হাঁপানি রোগী নিজে ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ধূমপান পরিহার করতে হবে।
>> আবহাওয়ার পরিবর্তন
>> খাবার-যেমনঃ কৃত্রিম রং এবং কিছু কিছু খাবার  ওষুধ, যেমনঃ এসপিরিন ও অন্যান্য ঘঝঅওউং এবং বেটা ব্লকার।

হাঁপানির উপসর্গ সমূহ:

>> ঘড়ঘড় করে শব্দসহ শ্বাস-প্রশ্বাস,  শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্থ হওয়া:
>> বুকে ব্যথা এবং
>> কাশি ইত্যাদি।

হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সময় শ্বাসনালীতে নিম্নোক্ত পরিবর্তনগুলো দেখা যায়:

>> শ্বাসনালী লাল ও ফুলে যাওয়ার ফলে সরু হয়।
>> শ্বাসনালীর চারপাশের মাংসপেশীসমূহ সংকুচিত হয়ে শ্বাসনালীকে আরো সরু করে দেয়।
>> শ্বাসনালীতে অধিক পরিমাণ শেস্নষা তৈরী হয়ে শ্বাসনালীতে বায়ুপ্রবাহ আংশিকভাবে বন্ধ করে দেয়।

চিকিৎসা:হাঁপানি একটি দীর্ঘ মেয়াদী রোগ। সঠিক চিকিৎসা এবং ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে হাঁপানি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যে সব উত্তেজকের (ট্রিগার) কারণে হাঁপানির তীব্রতা বেড়ে যায়, রোগীকে সেগুলো সণাক্ত করতে হবে এবং পরিহার করতে হবে। এছাড়াও সব হাঁপানি রোগীকে নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখতে হবে:

আরও পড়ুনঃ   ভয়াবহ কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার জেনে নিন

>> ধূমপান এবং তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে
>> ঠান্ডা বাতাস হাঁপানির তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এই সময় ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে।  ব্যায়াম এবং শারীরিক পরিশ্রম নিরুৎসাহিত করা উচিত নয়। ব্যায়াম শারীরিক ভাল রাখে এবং উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য জটিল রোগ বালাই থেকে শরীরকে রক্ষা করে। সঠিক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যায়ামের সময় বা পরে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা পরিহার করা সম্ভব।
>> বাড়ীর পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং বাড়ীতে অবাধ বিশুদ্ধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ওষুধ সমূহ:দু’ধরণের ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যেমন: হাঁপানি প্রতিরোধক ও হাঁপানি উপশম কারক।

হাঁপানি প্রতিরোধক:যেসব ওষুধের ব্যবহার হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হওয়া প্রতিরোধ করে তাদেরকে হাঁপানি প্রতিরোধক বলা হয়।

দু’প্রকারের ওষুধ হাঁপানি প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে:

>>এন্টি ইনফ্লামেটরী ওষুধসমূহ: এইসব ওষুধ শ্বাসনালীর প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হাঁপানি প্রতিরোধ করে। এই শ্রেণীর বহুল ব্যবহূত বুসোনাইড, ক্লোমিথাসেন এবং ফ্লুটিকাসোন ইত্যাদি।
>> ব্রঙ্কোডাইলেটর বা শ্বাসনালী প্রসারক: এইসব ওষুধসমূহ দ্রুত শ্বাসনালীকে প্রসারিত করে হাঁপানির তীব্রতা প্রতিরোধ করে।

হাঁপানি উপশম কারক:ব্রঙ্কোডাইলেটর সমূহ উপশম কারক হিসেবে কাজ করে। ব্রঙ্কোডাইলেটর সমূহ শ্বাসনালীকে দ্রুত প্রসারিত করে ফলে ফুসফুসে সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে এবং এর মাধ্যমে হাঁপানি আক্রান্ত রোগীর উপসর্গসমূহ দ্রুত উপশম হয়।

দু’ধরণের ব্রঙ্কোডাইলেটর বা শ্বাসনালী প্রসারক আছে, যেমন:

>> ক্ষণস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর-যেমন:সাল-বিউটামল। এইসব ওষুধ দিতে ৩-৪ বার ব্যবহার করতে হয়।
>> দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর-যেমন: ব্যামবিউটামল। এইসব ওষুধ দিনে একবার ব্যবহার করতে হয়। মৃদু বা মাঝারী হাঁপানিতে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষণস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর (যেমনঃ সালবিউটামল) ব্যবহার করলে কোন ধরণের ক্লিনিক্যাল সুবিধা পাওয়া যায় না। তাই এইসব ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কোডাইলেটর (যেমনঃ ব্যামবিউটামল) ব্যবহার করতে হবে।

রাত্রিকালীন হাঁপানিতে মোডিফাইড রিলিজড থিওফাইলিনের বিকল্প হিসাবে ব্যামবিউটামল ব্যবহার করে ভাল সুফল পাওয়া যায়।

আরও পড়ুনঃ   অ্যাজমা সম্পর্কে জানুন- হাঁপানি (অ্যাজমা) কি?

হাঁপানির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া:

>> অনেক রোগীই হাঁপানি চিকিৎসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা বলে কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত হাঁপানি আরো ভয়াবহ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
>> সঠিক চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবহারের মাধ্যমে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ না করলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং অকেজো হবে।
>> শিশুদের হাঁপানির ঠিকমত চিকিৎসা না করালে বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মায়েদের বেলায় গর্ভস্থ ভ্রণের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

হাঁপানি চিকিৎসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: করটিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার ওরাল ক্যানডিয়াসিস সৃষ্টি করতে পারে। যেসব রোগী ইনহেলারের মাধ্যমে করটিকোস্টেরয়েড ব্যবহার করে তাদের অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট (যেমনঃ অসটোক্যাল/ অসটোক্যাল জেধার) গ্রহণ করা উচিত।

থিওফাইলিন এবং এ জাতীয় ওষুধসমূহ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং রোগীকে অবসন্ন করে দেয় বলে থিয়োফাইলিনের পরিবর্তে দীর্ঘ মেয়াদী ব্রঙ্কোডাইলেটর-যেমনঃ ব্যামবিউটামল (ডাইলেটর) ব্যবহার করা উচিত।

**************************
ডাঃ এ, কে, এম, মোস্তফা হোসেন
পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতাল
মহাখালী, ঢাকা-১২১২।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × one =