বংশগত জটিল রোগ থ্যালাসেমিয়া

0
783
genetic thalassemia, বংশগত থ্যালাসেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া

এক সুখী দম্পতি। একদিন তাদের কোলে আসে ছোট্ট শিশু নিঝুম। কিন্তু হঠাৎই বদলে যায় এই সুখের দৃশ্যপট। নিঝুমের বয়স যখন এক কি দেড় তখন থেকেই তাকে কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখাতে থাকে। সাথে খাওয়ায় অরুচি। বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নিঝুমের রক্তে ধরা পড়ে একটি জটিল রোগ থ্যালাসেমিয়া।

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। এই রোগ শরীরে রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করে যা রক্তের মধ্যে ত্রুটিযুক্ত হিমোগ্লোবিনের জন্য হয়ে থাকে। হিমোগ্লোবিন মানুষের রক্তের খুব দরকারি একটি উপাদান। এটি রক্তের একটি বিশেষ রঞ্জক পদার্থ যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহন করে। স্বাভাবিক মানুষের রক্তে হিমোগ্লোবিন সাধারণত দু’টি আলফা ও দু’টি বিটা চেইন বহন করে। এ দু’টি চেইনের যে কোনো একটি পরিমাণে কম থাকলে সৃষ্টি হয় থ্যালাসেমিয়া রোগের।

দু’রকমের থ্যালাসেমিয়া : থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে, আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। যাদের হিমোগ্লোবিনে আলফা অথবা বেটা চেইন পরিমাণে কম থাকে, তাদের বলা হয় আলফা অথবা বেটা থ্যালাসেমিয়া । আলফা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

পরিসংখ্যান যা বলে : প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটির বেশি লোক বিভিন্ন ধরনের বেটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। ফলে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে।

আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে তিন শতাংশ লোক বেটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক, চার শতাংশ অন্যান্য ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন রোগের বাহক। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ লোক এ রোগে আক্রান্ত। দক্ষিণ এশিয়ার অপর একটি দেশ মালদ্বীপে এই রোগের হার সর্বোচ্চ। প্রায় ১৮ শতাংশ।

আরও পড়ুনঃ   থ্যালাসেমিয়া কী? থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা কী?

থ্যালাসেমিয়ায় কি হয় : রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল তিন মাস। লোহিত কণিকা অস্থিমজ্জায় অনবরত তৈরি হচ্ছে এবং তিন মাস শেষ হলেই প্লীহা এ লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। তাদের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে প্লীহা আয়তনে বড় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে হৃৎপিন্ড, প্যানক্রিয়াস, যকৃত, অন্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়।

থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত যেসব লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা যায় : অবসাদ অনুভব, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্থি, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), মুখের হাড়ের বিকৃতি, নাকের হাড় দেবে যাওয়া (মঙ্গোলয়েড ফেস), শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, গাঢ় রঙের প্রস্রাব।

চিকিৎসা ঃ থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা বলতে রক্ত পরিসঞ্চালন। আর মাঝে মাঝে অতিরিক্ত পরিসঞ্চালন জনিত আয়রন উদ্বৃত্তি ঠেকাতে আয়রন চিলেশন থেরাপী, সাধারণত ডেসফেরিঅক্সামিন দেওয়া হয়। ওষুধের চিকিৎসা বলতে এটুকুই। প্লীহা বড় হয়ে গেলে অপারেশন করে সেটা ছোট করে দেওয়া হয়। এতে রক্তগ্রহণের হারটা কমে আসে কিছুটা। মূলত বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন হলো এর স্থায়ী চিকিৎসা। এটা খুবই ব্যয়বহুল। আমাদের পাশের দেশে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনে খরচ পড়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। আমাদের দেশে এই চিকিৎসা এখনো শুরু হয়নি। তবে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এটা বাংলাদেশেও করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজী বিভাগে ও জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা হাসপাতালে বোনম্যারো চিকিৎসা শুরু করার জন্য সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি চলছে। এটা আশার কথা।

নিয়মিত যা করণীয়ঃ

i) নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো।

আরও পড়ুনঃ   নিউরোফাইব্রোমেটোসিস (Neurofibromatosis)

ii) রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রাম/ ডেসিলিটার রাখার চেষ্টা করতে হবে।

iii) হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা দেওয়া।

iv) শিশুরোগীর ক্ষেত্রে প্রতি তিন মাস অন্তর উচ্চতা, ওজন, লিভার ফাংশন টেস্ট করাতে হবে।

v) আট থেকে ১০ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর রক্তে লৌহের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে।

vi) রক্তে লৌহের মাত্রা এক হাজার ন্যানো গ্রাম বা মিলি লিটারের ওপরে হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।

vii) বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করা।

viii) শিশুর প্রতিবছর বুদ্ধি ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা।

প্রতিরোধে চাই সচেতনতা ঃ

এ রোগ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি বাড়াতে প্রচার মাধ্যমের ব্যাপক অংশ গ্রহণ প্রয়োজন। টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও, ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ, টুইটারে ব্যাপক আলোচনা দরকার। গর্ভাবস্থায় রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করতে হবে। বিভাগীয় শহরগুলোতে অন্তত জেনেটিক পরামর্শকেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। এ রোগটি একেবারে নির্মূল করতে জেনেটিক কাউন্সেলিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে এই বিশাল সংখ্যার রোগীর যদি আর বৃদ্ধি না চাই, তাহলে এখনই আইন করে আন্তঃ-থ্যালাসেমিক পরিবারে বিয়ে বন্ধ করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের বাহকদের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করতে হবে।

আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই সহজ। তাই একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচি ও পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগ দরকার।

পরিশেষে : সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় নয় লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। বাংলাদেশে এর সংখ্যা হচ্ছে আনুমানিক ১০ হাজার। বিশ্বের কয়েকটি দেশ, যেখানে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি ছিল, সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচির মাধ্যমে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর জন্ম প্রায় শূন্য বা শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে তারা।

উদাহরণস্বরূপ সাইপ্রাসের কথা ধরা যাক। ১৯৭০ সালে সেখানে প্রতি ১৫৮ জন শিশুর মধ্যে একটি শিশু জন্ম নিত থ্যালাসেমিয়া নিয়ে, আজ সেখানে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নেয়ার সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। গ্রিস, ইতালিসহ অনেক দেশই থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছে। এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরও । সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চাই ব্যক্তিগত সচেতনতা।

আরও পড়ুনঃ   মৃগীরোগঃ ভুল ধারণা আর নয়

অধ্যাপক ডা. এ. বি. এম. ইউনুছ, ব্লাক ক্যান্সার ও রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক থ্যালাসেমিয়া বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববদ্যালয়, চেম্বার-গ্রীন ভিউ ক্লিনিক, গ্রীন রোড, ঢাকা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × three =