আবুল খায়ের: জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নকল ও ভেজাল নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ভেজালকারীদের এ দোর্দণ্ড প্রতাপ কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, বেড়ায় ক্ষেত খেলে বেড়া দিয়ে লাভ নেই। ভেজাল ও নকল ওষুধ যারা নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসন তাদের মধ্যে এক শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়মিত মাসহারা পেয়ে আসছে। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার কারণে ভেজাল নকল ওষুধ পাইকারি বিক্রেতার প্রভাব দিন দিন বেড়ে চলছে। এখন নিয়ন্ত্রণহীন। কিডনি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, লিভার রোগসহ বিভিন্ন রোগে ওষুধ পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। এ ছাড়া এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ধরনের নকল ওষুধ পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়ে আসছে। দেশি ও বিদেশি নামি-দামি কোম্পানির উত্পাদিত কিডনি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, লিভার রোগের এবং এন্টিবায়োটিকসহ বভিন্ন ধরনের ওষুধ হুবহু নকল ও ভেজাল করে এ সকল ওষুধ দেশের বৃহত্তম ওষুধের মার্কেট মিটফোর্ডে পাইকারি বিক্রি হয়ে আসছে। এ সকল মার্কেট থেকে নকল ও ভেজাল ওষুধ সারাদেশে যাচ্ছে। ঐ সকল ওষুধের গায়ে লেভেল কিংবা প্যাকেট দেখে আসল ও নকল বুঝার উপায় নেই। মাঝে মাঝে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে তত্ত্বাবধানে মিটফোর্ডসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল ও নকল ওষুধ বিক্রেতাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাও হয়ে থাকে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঐ অভিযান পরিচালনাকারীদের লেনদেনের সখ্যতা দীর্ঘদিনের। এ মোটা অঙ্কের উেকাচ জায়েজ করতে মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান বলে ওষুধ বিক্রেতাকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। এ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারাও নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রেতাদের শাস্তি চায়। প্রশাসনের দুর্বলতা কিংবা মোটা অঙ্কের উেকাচ লেনদেনের কারণে ভেজাল ও নকল ওষুধ ব্যবসায়ীদের কাছে ওষুধের মার্কেট জিম্মি বলে সমিতির কতিপয় কর্মকর্তা জানান।
র্যাব সদর দফতরের ইন্টিলিজেন্স উইংয়ের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন এবং বাজারজাতকারীদের মনিটরিং করে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ভেজাল ও নকল ওষুধ উত্পাদন এবং বাজারজাতকারীদের শনাক্ত করে। তাদের তালিকাও গোয়েন্দা কর্মকর্তা করেন।
কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের বাজারজাত নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গভীর রাতে কার্ভাডভ্যান ও কুরিয়ার সার্ভিসযোগে মিটফোর্ডে বস্তায় বস্তায় নকল ও ভেজাল ওষুধ যায়। এ সকল ওষুধ গুদামজাত করে মাসের পর মাস মিটফোর্ডের এক শ্রেণির ব্যবসায়ী পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করে আসছে। গতকাল বৃহস্পতিবার র্যাব-১০ এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উদ্যোগে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট মিটফোর্ডে রহিম মার্কেটে অভিযান চালায়। সেখানে ৭টি নকল ও ভেজাল ওষুধের গোডাউনের সন্ধান পায় মোবাইল কোর্ট। এই সাতটি গোডাউন থেকে দেশি ও বিদেশি নামিদামি কোম্পানির বিপুল পরিমাণ নকল ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করে। ওষুধের মধ্যে কিডনি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও লিভার রোগের ওষুধ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। মোবাইল কোর্ট সাতটি গোডাউনের মালিককে জেল ও জরিমানা করে। প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের নকল ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করে মোবাইল কোর্ট। মেসার্স বিক্রমপুর ড্রাগসের মালিক মো. দেলোয়ার হোসেনকে দুই লাখ টাকা, মেসার্স শাওন ড্রাগ স্টোরের মালিক মো. শাহনেওয়াজকে দুই লাখ টাকা, মেসার্স নোমান ড্রাগস হাউজের মালিক মো. নজরুল ইসলামকে আড়াই লাখ টাকা, মেসার্স বাশার ড্রাগ হাউজের মালিক মো. বাশার মিয়াকে দেড় লাখ টাকা, মেসার্স সুলতান ড্রাগ স্টোরের মালিক মো. মনিরুল খানকে এক লাখ টাকা, মেসার্স টুম্পা ড্রাগস হাউজের মালিক হাজী আব্দুল কাদেরকে এক লাখ টাকা ও মেসার্স শাকিল ড্রাগ স্টোরের মালিক মো. শাহজাহানকে এক লাখ টাকা জরিমানা করে মোবাইল কোর্ট।
ক্যান্সার, কিডনি, লিভার ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকগণ বলেন, এ ধরনের নকল ও ভেজাল ওষুধ রোগীদের ব্যবহারে মৃত্যু দ্রুত নিশ্চিত। নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবনে প্রতিদিন অনেক রোগীর নিরবে প্রাণহানি ঘটছে। নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন এবং বাজারজাতকারী জেনেশুনে রোগীদের হত্যা করে আসছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশে ভেজাল ওষুধ ও খাদ্য উত্পাদন এবং বাজারজাতকারীদের মৃত্যুদণ্ড রয়েছে। কোনো কোনো দেশ প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে থাকে। এ কারণে ঐ সব দেশে ওষুধ কিংবা খাদ্যসামগ্রীসহ কোনো পণ্য নকল ও ভেজাল উত্পাদন অথবা বাজারজাত করার সুযোগ নেই বলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানান।
এদেশে হাজার হাজার রোগীর হত্যাকারী নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন কিংবা বাজারজাতকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ড ছাড়া তাদের নিয়ন্ত্রণে কোনো বিকল্প নেই বলে চিকিত্সকদের দাবি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ভেজাল ও নকল ওষুধ উত্পাদন কিংবা বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চলছে। এ অবস্থা চলমান। তাদের কোনো অবস্থায় ছাড় নেই বলে তিনি জানান।