ক্যান্সারে জরায়ু না ফেলেই মৃত্যুঝুঁকি এড়ান

0
824
জরায়ু ক্যান্সার

মাতৃত্ব ও নারীত্বের জন্য অপরিহার্য এবং নারীদের সংবেদনশীল অঙ্গ জরায়ু। শতকরা ৫০ ভাগের বেশি নারীই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে জরায়ু মুখের ক্ষত (Cervicitis) ও প্রদাহে (Cervical Erison) ভুগে থাকেন। আর এই জরায়ু মুখের ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী নারীমৃত্যুর অন্যতম কারণ।

বিশ্বে দৈনিক গড়ে সাতশ’ নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতি বছর নতুন করে ৫০ লাখ নারী এতে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার নারী নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ১০ হাজার জন এ রোগে মৃত্যুবরণ করেন। এদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৭ জন নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন।

বাচ্চা প্রসব, গর্ভপাতের (এমআর, ডিঅ্যান্ডসি) পর অথবা যেকোনো সময় বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাসের সংক্রমণ, বাহ্যিক আঘাত, জন্মবিরতিকরণ রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও ঋতুস্রাব চলাকালীন ব্যবহার্য বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে জরায়ু মুখের প্রদাহ সৃষ্টি হয়। আর যখন জরায়ু মুখের বাইরের দৃঢ় শক্ত আবরণী (Squamous Epithelium) অভ্যন্তরীণ পাতলা আবরণী (Columnar Epithelium) দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়, তখন ক্ষতের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘস্থায়ী জীবাণু সংক্রমণ কোনো কোনো সময় ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। যৌন-সক্রিয় প্রতিটি নারীই অপরিচ্ছন্ন যৌন আচরণ ও সংস্পর্শের মাধ্যমে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।

সাধারণত, সংক্রমণের শুরু থেকে ২০ বছরের মধ্যে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ১৫ থেকে ৬০ বছরের নারীদের জরায়ু মুখের প্রদাহ, ক্ষত ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট জীবাণুগুলোর মধ্যে শুধু এইচপি (hp) ভাইরাসের প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে।

ক্ষত বা প্রদাহের লক্ষণ: মাসিকের রাস্তায় অতিরিক্ত স্বচ্ছ বা হলদেটে স্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব বা লিকোরিয়া, সহবাসের সময় ব্যথা, সহবাসের সময় রক্তপাত, জননাঙ্গে চুলকানি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, জরায়ুর বাহ্যিক অবস্থান বা আকার পরিবর্তন, কোমড়ের পেছনে ব্যথা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না।

আরও পড়ুনঃ   গর্ভকালীন কোমর ব্যথা দূর করতে করণীয়

প্রতিক্রিয়া: জরায়ু, ডিম্বনালী, ডিম্বাশয় প্রদাহসহ বন্ধাত্ব দেখা দিতে পারে। গর্ভবতী নারীরা এ রোগে আক্রান্ত হলে গর্ভপাত, অকাল প্রসব ছাড়াও নবজাতকের নিমোনিয়া ও চোখের সংক্রমণ হতে পারে।

রোগ নির্ণয়: ব্যথামুক্ত ও সাশ্রয়ী কল্পোস্কপি পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই এ রোগ নির্ণয় করা যায়। বিবাহিত নারীদের প্রত্যেকেরই প্রতি দুই বছরে একবার এ পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো।

চিকিৎসা: প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ও সমজাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বারবার প্রচলিত চিকিৎসা করেও যখন রোগীর আরোগ্য লাভ হয় না, তখন সাধারণত নারীদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি অপারেশনের মাধ্যমে কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়।

জরায়ু কেটে ফেললে যেসব সমস্যা হয়: সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, বদরাগী বা বদমেজাজি হওয়া, মুখে চুলের বৃদ্ধি, জয়েন্ট ও হাড়ে ব্যথা, চামড়া কুচকে যাওয়া, স্ত্রীলিঙ্গে দীর্ঘায়িত রক্তক্ষরণ, অনুভূতি কমে যাওয়া ও শুষ্কতা বা ভ্যাজাইনাল লুব্রিকেন্টের অনুপস্থিতি, যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, মাতৃত্ব আবেগের ক্ষতি, স্নায়ুবিক দুর্বলতা ও স্মৃতি অবক্ষয়, আত্মহত্যার চিন্তা, সহবাসের সময় ব্যথা ও অস্বস্তি, মূত্রনালীতে ঘা, স্ত্রীলিঙ্গের এবং স্তনবৃন্তের অনুভূতি কমে যাওয়া। আর এসব কারণে দাম্পত্য ও সংসার জীবনে নেমে আসে সীমাহীন যন্ত্রণা ও অশান্তি।

তবে বিশ্বের উন্নত দেশের মতো জরায়ু কেটে না ফেলে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেও হচ্ছে। কাটা-ছেঁড়া ছাড়া, রক্তপাতহীন ও ঝুঁকিমুক্ত অত্যাধুনিক লেজার ভেপোরাইজেশন পদ্ধতির চিকিৎসা। এ পদ্ধতিতে জরায়ু অপসারণ বা কেটে না ফেলে নারীত্ব ও মাতৃত্ব অক্ষুণ্ন রেখে স্বল্প সময়ে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।

লেখক: ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী
পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি অ্যান্ড হসপিটাল

আরো পড়ুনঃ  ভয়ংকর জরায়ুর ক্যান্সারের কিছু দৈনন্দিন উপসর্গ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × two =