কিডনিতে পাথর? কিডনিতে পাথর জমার লক্ষণ বুঝবেন যেভাবে

0
1040
কিডনিতে পাথর জমার লক্ষণ

কিডনি হচ্ছে আমাদের দেহের রক্ত পরিশোধনের অঙ্গ। আমরা যেসব খাবার খেয়ে থাকি তার পুষ্টি সরাসরি আমাদের দেহে ছড়ায় না। বরং খাবার গ্রহনের পর তার একটি অংশ কিডনি থেকে রক্তে যায়। এবং রক্তের মাধ্যমে পুরো দেহে সঞ্চালিত হয়। এছাড়াও শরীরে জমে থাকা অনেক রকম বর্জ্যও পরিশোধিত হয় কিডনিতে। কিডনির নানা সমস্যার মধ্যে সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে কিডনিতে পাথর হওয়া। কিডনির পাথর জমা বেশ মারাত্মক একটি পরিচিত সমস্যা। কিডনির ভিতরে কঠিন পদার্থ জমা হয়ে কিডনিতে পাথর হয়। এটি সাধারণত আকারে ছোট হয়ে থাকে। কিডনিতে নানা কারণে পাথর হতে পারে। খনিজ পদার্থ, অম্ল ও লবণের মিশ্রণে কিডনির পাথর তৈরি হয়। প্রস্রাব ঘনিভূত হয়ে খনিজ পদার্থগুলো দানা বাঁধে এরপর সেগুলো পাথরে রূপান্তরিত হয়।

বিভিন্ন কারণে কিডনিতে পাথর হয়ে থাকে। তবে প্রস্রাব গাঢ় হলে তা খনিজগুলোকে দানা বাঁধতে সহায়তা করে এবং তা পাথরে রূপ নেয়।

কিডনিতে পাথর জমলে তা যে কারও জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। উপসর্গ বা লক্ষণগুলো জানা থাকলে নিরাময়ে সুবিধা হবে আপনার। কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

# কিডনিতে পাথর হলে ঠিকমতো বসতে, দাঁড়াতে, কিংবা শুয়ে থাকতে সমস্যা হতে পারে। পেটে অসহ্য যন্ত্রনা হওয়ার পাশাপাশি সবসময়ই অস্বস্তি বোধ হতে পারে আপনার।

# কিডনিতে পাথর  জমা হয়ে কখনো বা প্রসাবে রক্ত দেখা দিতে পারে।

#পাজরের দুইপাশে কিংবা পিঠে ও তলপেটে ব্যথা হতে পারে।

#প্রসাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, প্রসাবকালে ব্যথা হওয়ার পাশাপাশি মূত্রের রঙ গোলাপি, লাল বা গাঢ় রঙের হতে পারে। শুধু তাই নয়, জ্বর এবং বমি-বমি ভাব হতে পারে আপনার।

#  তবে,একেকজনের উপসর্গ একেকভাবে দেখা দিতে পারে। এ লক্ষণগুলোর সবই যে একজনের মধ্যে দেখা দেবে তা নয়। পাথরের আকৃতি এবং কিডনির কোনস্থানে পাথর জমেছে তার উপর উপসর্গগুলো নির্ভর করে।

#কিডনিতে পাথর হলে পিঠে কিংবা পাজরের দুইপাশে, তলপেটে ব্যথা হয়, প্রসাবের পরিমাণ বেশি থাকে, প্রসাবের সময় ব্যথা হয়, ইউররিনের রঙ গোলাপি, লাল, বাদামি কিংবা গাঢ় রঙের হয়। জ্বর এবং বমি বমি ভাবও হয়।

আপনার শরীরে উপরের লক্ষণগুলোর যেকোন একটি দেখা দিলে, নিজের কাছে সন্দেহ হলে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না যেন।

আরও পড়ুনঃ   মূত্রনালীর সংক্রমণ ও প্রদাহ

তথ্যসূত্র : হেলথলাইন

সম্প্রতি এ বিষয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের প্রধান পরামর্শক অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ।

প্রশ্ন : কিডনির কোন অংশে পাথর হয়? পাথর হয় কেন?

উত্তর : কিডনির যেসব রোগ বের করা গেছে তার মধ্যে পাথর একটি পুরনো রোগ। পাথরগুলো কেবল কিডনিতে নয়, এর বিভিন্ন অংশে হতে পারে। কিডনিতে হতে পারে। কিডনির ভেতর থেকে বের হওয়া বৃক্ক নালীতে হতে পারে, প্রস্রাবের থলেতে হতে পারে এবং থলের থেকে বের হয়ে অনেক সময় পাথর মূত্রনালিতে আটকা পড়ে।

পাথর কেন হয় এর উত্তর দেওয়া মুশকিল। কেননা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন অনেক ক্ষেত্রে কারণ জানাই যায় না। তবে এটা জানা গেছে যে প্রত্যেকের দেহে পাথর যাতে না হয় এমন কিছু নিরোধক পদার্থ রয়েছে। সেই উপাদানগুলো যদি কম থাকে সেসব ব্যক্তির পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি।

প্রশ্ন : সেই উপাদনগুলো কী? পাশাপাশি জানতে চাইব, অনেকের ক্ষেত্রে পাথর একদমই হয় না আবার অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো বার বার হয়। এর কারণ কী?

উত্তর : বংশগতভাবে এই সমস্যা হতে পারে। জীবনযাপনের কারণেও এটি হতে পারে । যারা পানি কম খায় তাদের এই সমস্যা হতে পারে। যারা মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে তাদের প্রচুর ঘাম হয়, তাদেরও পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি। যারা ক্যালসিয়াম জাতীয় ট্যাবলেট প্রচুর পরিমাণে খায় এদেরও পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যাদের ঘন ঘন কিডনিতে ইনফেকশন হয় তাদের এই সমস্যা হতে পারে। আবার কিছু রোগের ক্ষেত্রে যেমন হাইপার পেরাথাইরোয়েডিজম অর্থাৎ পেরাথাইরোয়েড গ্রন্থি থেকে কিছু হরমোন বের হয়, এটি হলে তাদের পাথর বেশি হয়ে থাকে। আবার কিছু জন্মগত কারণ রয়েছে। যেমন : টিউবুলার এসিডোসিসি। কিডনির এ ধরনের রোগের কারণেও পাথর হতে পারে।

প্রশ্ন : একজন ব্যক্তি পাথরে আক্রান্ত হলে তার কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে?

উত্তর : লক্ষণ নির্ভর করে পাথরটি কোন জায়গায় আছে এবং সেটার আকৃতি কতটুকু তার উপরে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো পাথর টেনিসবলের মতো হয়ে গেছে, কিডনির ভেতরে পকেট আছে। আবার দেখা যায়, ছোট্ট একটা মটরশুটির মতো পাথর বৃক্কনালির মধ্যে গড়িয়ে এসে আটকা পড়েছে। এর কারণে তীব্র ব্যথা হয়। ব্যথাটি কিছুক্ষণ থেমে আবার হয়।

আরও পড়ুনঃ   কিডনি ঠিক আছে তো?

প্রশ্ন : সাধারণত কোন জায়গায় ব্যথা হয়?

উত্তর : যদি কিডনিতে পাথর থাকে তবে কোমড়ের দুইপাশে নাভীর উপরের দিকে ব্যথা হয়। যদি পাথর কিডনি নালিতে চলে আসে তাহলে সামনের দিক থেকে কুচকি পর্যন্ত, এমনকি জনন ইন্দ্রিয় পর্যন্ত ব্যথা চলে আসতে পারে। ব্যথার পাশাপাশি কারো কারো প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যায়। অনেক সময় টাটকা রক্ত আসে, আবার প্রস্রাবের সঙ্গে মিশে ঘোলা হয়ে রক্ত আসতে পারে। আবার অনেক সময় পাথর ভেতরে আটকে থাকার জন্য ঘা হতে দেখা যায়। তখন ব্যথা হয় এবং কাপুনি দিয়ে জ্বরও আসতে পারে। সাধারণত রোগীরা এ ধরনের লক্ষণই নিয়ে আসে। তবে কখনো কখনো কোনো লক্ষণ ছাড়াই পাথর বড় হয়ে যেতে পারে কিডনির ভেতরে।

প্রশ্ন : একজন রোগীর এ রকম লক্ষণ দেখা দিলে আপনার কীভাবে নিশ্চিত হন এই সমস্যা কিডনি থেকে হয়েছে?

উত্তর : শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই এক্স-রে করে দেখা যায় পাথর কোথায় আছে। এর মাধ্যমে পাথরটা কোন জায়গায় আছে এবং এর আকৃতি কতটুকু সেটা মোটামুটি বোঝা যায়। এছাড়া আল্ট্রাসোনোগ্রাম করা হলে আরো পরিষ্কার হওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাথরটি যদি নিচে চলে আসে, তখন সেটাকে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য ইন্টারভেনাস ইউরোগ্রাফি বা আইভিও করে পরীক্ষা করা হয়। এরপরও যদি কোনো দ্বিধা থাকে তাহলে সিটি স্ক্যান এবং এমআরআইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়। তা ছাড়া আরো কিছু পরীক্ষা করা হয়। ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখা হয় কোন কোন উপাদানগুলো প্রস্রাবের সঙ্গে যাচ্ছে। এগুলো বের করার চেষ্টা করা হয় যেন সমস্যাটি বারে বারে না হয় এর জন্য। যে উপদানগুলো বেশি আছে সেই খাদ্যগুলো পরিহার করতে বলি এবং তার জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক ওষুধ দেই।

প্রশ্ন : এক সময় আমরা জানতাম কিডনির পাথর মানেই অপারেশন করা। কিন্তু এখন অনেক আধুনিক পদ্ধতি বের হয়েছে চিকিৎসার জন্য। একটু বলবেন, কী কী আধুনিক পদ্ধতি রয়েছে? পাশাপাশি আরেকটি বিষয় জানতে চাইব, কিডনি ক্র্যাশ বা পাথর ভাঙ্গা এই বিষয়গুলো এখন অনেক উচ্চারিত হয়, এগুলো কী?

উত্তর : একটা সময় আমরা ভাবতাম যেকোনো পাথর মানেই অপারেশন করতে হবে।এখন কিন্তু শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে কোনো অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে না। আর যদি দরকার পড়েও তখন লেপারোস্কোপি করেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাথর বের করে আনা যায়।

আরও পড়ুনঃ   শাকসবজি রান্নার স্বাস্থ্যকর উপায় জানেন?

অনেক সময় পত্রপত্রিকায় দেখা যায় হারবাল বা হোমিও ওষুধ খেয়ে পাথর মুক্ত হয়ে গেছে। একটা বিষয় বলে রাখি, পাথরের পরিমাপ যদি ৬ মিলিমিটারের নিচে হয় তাহলে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে পাথর এমনিতেই বেরিয়ে যাবে। কোনো ওষুধের প্রয়োজন পড়বে না। শুধু পানি খেলেই হবে এবং একটু জগিং করতে হবে। সেই সঙ্গে আমরা দুটো ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার এবং টেমসোলসিন।আর এর থেকে বড় হলে অন্য চিকিৎসাগুলোর প্রয়োজন।

অন্য উপায়ে চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে স্টোন ক্র্যাশ। এটি এমনই একটি পদ্ধতি যেখানে পেট কাটার প্রয়োজন পড়ে না।শুধু রোগী শুয়ে থাকবে, পাশে একটি যন্ত্র থাকবে যেখানে শক ওয়েব তৈরি করে দেওয়া হয়। পানির মধ্য দিয়ে সেই ওয়েভটা কিডনিতে ধাক্কা দেবে। ধাক্কা দিয়ে পাথরকে গুঁড়ো করে দেয়। প্রস্রাবের সঙ্গে এই গুঁড়োগুলো বেরিয়ে আসে। আর যাদের নালিতে পাথর অনেক বড় হয়ে আটকা পড়েছে; এমনিতে বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই সেই ক্ষেত্রে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে একটি টিউব ঢুকিয়ে, প্রস্রাবের থলেতে গিয়ে, থলের থেকে বৃক্ক নালিতে গিয়ে, পাথরের কাছে গিয়ে এক ধরনের ভাইব্রেশন দিয়ে সেটাকে গুঁড়ো করে দেওয়া হয়। এই গুঁড়ো প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে।

আর যদি প্রস্রাবের নালিতে বা থলেতে পাথর থাকে তবে অবশ্যই সেটা টিউব দিয়ে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে বের করে আনা হয়।

এভাবে বেশিরভাগ সময় অপারেশনের দরকার পড়ে না। আর যদিও দরকার পড়ে তবে লেপারোস্কোপি করে পেটে ছোট তিনটি ছিদ্র করে বের করে দেওয়া হয়।

কিছু সাধারণ উপদেশ
কিডনিতে পাথর হলেই অপারেশন করতে হয় এমন ধারনা ঠিক নয়। ছোট অবস্থায় ধরা পরলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ওষুধ সেবন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব, কারণ ছোট আকৃতির পাথর সাধারণত প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়।

মনে রাখা প্রয়োজন, দৈনিক ৮-১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করলে শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ উপযুক্ত পরিমাণে প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায় এবং কিডনির পাথরের ঝুঁকি এবং জটিলতা কমিয়ে আনে।

কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ কী?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

twenty − 3 =