অশ্বগন্ধার এই গুণগুলির কথা জানতেন?

0
1804
অশ্বগন্ধার গুণ

অশ্বগন্ধা খুব ছোট, শক্ত কাঁটাবিশিষ্ট, খাড়া ও শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট একটি গাছ। এটির পাতাগুলো দেখতে অনেকটা খচ্চরের কানের মতো এবং বিপরীত দিকে ৮.১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। ঝোপঝাড় ও উচ্চতায় এবং কা-ের গঠন অনেকটা বেগুন গাছের মতো। পাতা ও ডাঁটার গায়ে রয়েছে সূক্ষ্ম লোম। বীজগুলো বেগুনের মতোই লালচে বর্ণের। গাছটিতে ছোট ছোট ফুল ধরে। আমাদের দেশের মতো নীতিশীতোষ্ণ দেশগুলোয় অশ্বগন্ধা জন্মিলেও গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বেশি জন্মে।

অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিক গুণে সমৃদ্ধ এক আশীর্বাদের মতো। বহু প্রাচীনকাল থেকে অশ্বগন্ধার ডাল, শেকড়, পাতা এবং ফল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি এনার্জি বৃদ্ধি সহ নানা রোগ সারাতে দারুণ কাজ দেয়। সংস্কৃততে অশ্বগন্ধা মানে ঘোড়ার মতো গন্ধ। এর কারণ অশ্বগন্ধা ব্যবহার করলে ঘোড়ার মতো তেজী এবং বলবান হওয়া যায়। বহু রোগ জাদুর মতো সারিয়ে তুলতে পারে এই প্রাকৃতিক উপাদানটি। স্নায়ুর রোগ থেকে থাইরয়েড, এমনকি ত্বকের যত্নেও অশ্বগন্ধা দারুণ কাজ করে। অশ্বগন্ধার কিছু উপকারি দিক…

১. ক্লান্তি দূর করে: অশ্বগন্ধা ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। আমাদের শরীর যখন খুব ক্লান্ত হয়ে পরে, তখন রোগ প্রতিরোধ সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই সময় অশ্বগন্ধা এন্ডোক্রাইন হরমোনের নিঃসরণে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে এবং আমাদের স্নায়ুকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। এরফলে ক্লান্তি খুব সহজে দূর হয়। এছাড়াও অশ্বগন্ধা আমাদের শরীরের ভিতর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতেও সাহায্য করে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে অশ্বগন্ধা দুশ্চিন্তা, স্নায়ুরোগ সহ নানারকম রোগের প্রতিকার করার কাজে ব্যবহৃত হত।

২.ঘুম আসতে সাহায্য করে: যেহেতু অশ্বগন্ধা ক্লান্তি দূর করে স্নায়ুকে আরাম প্রদান করতে পারে, তাই ঘুম আসে খুব তাড়াতাড়ি। এছাড়াও, খুব তাড়াতাড়ি চিন্তামুক্ত করে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে সাহায্য করে। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, অশ্বগন্ধা ব্যবহার করলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।

৩.ডায়াবেটিস রোধ করে: ডায়াবেটিসের সমস্যা এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার। যদিও এই সমস্যাকে কাবু করতে অশ্বগন্ধার জুড়ি মেলা ভার। প্রাচীনকালে অশ্বগন্ধার সঙ্গে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো। ২০০৯ সালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, অশ্বগন্ধার সঙ্গে শিলাজিত মিশিয়ে খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা সঠিক থাকে এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ জীবন দান করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ   অশ্বগন্ধার ব্যবহার-কীভাবে রূপচর্চায় অশ্বগন্ধার ব্যবহার করবেন? অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অশ্বগন্ধার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কী?

৪.বাতের সমস্যা দূর করে: অশ্বগন্ধা বাতের সমস্যা প্রাকৃতিকভাবে সারাতে পারে। বাতের সমস্যায় এমন বহু ওষুধ আছে, যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এদিকে অশ্বগন্ধা কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই বাতের সমস্যা সমাধান করতে পারে। এছাড়াও, হাঁটু এবং কনুই ফুলে যাওয়া ও ব্যাথা দূর করতে অশ্বগন্ধার জুড়ি মেলা ভার।

৫.মাংপেশিতে ব্যাথা: যারা খুব দুর্বল অথবা বয়স বেড়ে যাওয়ায় শরীরে জোর পান না, তাদের মাংসপেশিতে জোর আনতে অশ্বগন্ধা ব্যবহার করা হয়। এটি বাজারজাত ক্ষতিকারক স্টেরয়েডের থেকে অনেক ভাল এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন।

৬.ত্বকের যত্নে দারুণ উপকারি: অশ্বগন্ধা ত্বককে চিরনতুন এবং উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধা এস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। যা কোলাজেন তৈরি করে ত্বককে উজ্জ্বল রাখে। এছাড়াও অশ্বগন্ধার শেকড় প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।

৭.স্নায়ুরোগ সারাতে পারে: অশ্বগন্ধা আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসাবে খুব ভাল স্নায়ুর সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এটি স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতেও সাহায্য করে। আসলে অশ্বগন্ধার মধ্যে উপস্থিত শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৮.থাইরয়েডের সমস্যা দূর করে: থাইরয়েডের সমস্যা দূর করতে এখনও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা অশ্বগন্ধার সাহায্য নেন।

সূত্রঃ বোল্ডস্কাই

আরও ৬টি উপকারিতা জেনে নিন -লিখেছেনঃ দুলন প্রভা
১. শিশুকালের কার্শ্য রোগ: যাকে Emaciation বলে। এর কারণ হলো তার পুষ্টি, যেটা তার রসবহ স্রোত অথবা রক্তবহ স্রোতের স্বাভাবিক ক্রিয়াশীলতার অভাবেই হয়। এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে ওষুধ খেয়ে আর পুষ্টিকর খাবার খেয়ে স্বাস্থ্য ভাল হয় ঠিকই, কিন্তু একটি জায়গায় সমস্যা থেকেই যায় তাহলো শক্তিবহ স্রোতের হীনবলত্ব তো থেকে যায়। যখনই সে বিবাহিত হলো তখনই তার ঐ হীনশুক্রর জন্য খুবই অসুবিধ হতে থাকবে; সেক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা মূল চূর্ণ দেড় গ্রাম মাত্রায় প্রতিদিন সকালে ও বিকালে আধা কাপ গরম দুধে মিশিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ শুক্রের অপুষ্টি সমস্যা চলে যাবে।

২. শ্রমে ক্লান্তি দূর করতে: শরীরে তেমন কোনো রোগ নেই, হজমও হয়, দাস্ত পরিষ্কার হয়; শরীর যে খারাপ থাকে তাও নয়, অথচ তারা একটু পরিশ্রম করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে; তখনই ধরে নিতে হবে তার রক্তবহ স্রোতে দূর্বলতা এসেছে, অর্থাৎ অল্পেই তার হদযন্ত্রকে অধিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে; এক্ষেত্রে অনেকের দেখা যায় ধমনীর স্পন্দন দ্রুত হচ্ছে অর্থাৎ যেটা হলো চিরাচরিত প্রচলিত নাড়ী স্পন্দন। এই যে হৃদযন্ত্রের অত্যধিক চালনা হচ্ছে, এর জন্যেই সে ক্লান্তি অনুভব করছে, তাই এক্ষেত্রে অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ দেড় গ্রাম মাত্রা করে দু বেলা আধ বা এক কাপ গরম দুধে মিশিয়ে খেতে হবে। কয়েকদিন খাওয়ার পর ঐ মাত্রাটা আস্তে আস্তে বাড়িয়ে ৪ থেকে ৫ গ্রাম করে প্রতি বেলায় খেতে পারবেন। এইভাবে শুরু থেকে মাস দেড়েক খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ ক্লান্তি আর থাকবে না।

আরও পড়ুনঃ   নিয়মিত অশ্বগন্ধা খাওয়া উচিত কেন জানেন?

৩. শ্বাসে ও কাসে: যদি এদের শৈশবের ইতিহাসে শোনা যায় তাহলে বুঝা যাবে এরা ছোটবেলায় খুব ডিগডিগে চেহারার ছিলেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চেহারার পরিবর্তন হয়েছে। বটে, কিন্তু একটা সমস্যা তাঁদের শরীরে থেকে যায়নি, সেটা হচ্ছে অল্প ঠান্ডা লাগলে অথবা কোনো ঋতু পরিবর্তনের সময় তাঁদের সর্দি কাসি হবেই, তখনই বুঝতে হবে। শৈশবের অপুষ্টিই এই বিপাকে ফেলে দিয়েছে। এক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা মূল চূর্ণ এক গ্রাম থেকে ২ গ্রাম মাত্রায় সকালে ও সন্ধ্যায় অল্প গরম জল সহ খেতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে এটা প্রত্যক্ষভাবে শ্বাস-কাসের ওষুধ নয়; যাঁর পূর্ব ইতিহাস এই ধরনের ছিল, তাঁর ক্ষেত্রেই কাজ করবে।

৪. ফোড়ায়: অনেকে এটাতে ভুগে থাকেন। অনেকে বলে থাকেন যে, রক্ত খারাপ হয়েছে, কিন্তু জেনে রাখা ভালো রক্ত দূষিত হলে আরও কঠিন রোগ আসে, যেমন কুষ্ঠ ও বাতরক্ত। কোনো কারণে রক্তবিকৃত হয়ে এই ফোড়া হয়, যদি এই বিকারকে সরিয়ে ফেলা যায় তাহলে ফোড়া আর হবে না, সেক্ষেত্রে অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ এক থেকে দেড় গ্রাম মাত্রায় আধ কাপ গরম দুধের সঙ্গে সকালে ও বিকালে দুবার খেলে ঐ রক্তবিকারটা চলে যাবে, আর ফোড়াও হবে না। তবে প্রারম্ভিক মাত্রা কিন্তু এক গ্রামের বা ৭ থেকে ৮ রতির বেশি নয়।

৫. শ্বেতী রোগে: এই শ্বেতী কতো গভীরে প্রবেশ করেছে সেটা বোঝার উপায় হলো দাগগুলি দুধের মতো সাদা হয়ে গেলে বুঝতে হবে যে, এ রোগাক্রমণ মাংসবহ স্রোত পর্যন্ত হয়েছে; আর দাগগুলি একটু লালচে হলে বুঝতে হবে, এটা রক্তবহ স্রোতের এলাকায় আছে; আর যখন আবছা সাদা দাগ দেখা যাবে তখন বুঝতে হবে, এখন সে রসবহ স্রোতের এলাকায় আছে; আর অশ্বগন্ধার মূল তখনই কাজ করে যখন এই রোগ রসবহ ও রক্তবহ স্রোতের এলাকায় থাকে; এ অবস্থার ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধার মূল চূর্ণ দেড় বা দুই গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে দুবেলা দুধসহ খেতে হবে। আর কাঁচা অশ্বগন্ধার গাছের পাতা ও মূল একসঙ্গে ১০ গ্রাম নিয়ে একটু থেঁতো করে, ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে সিকি কাপ বা তারও কম থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ঐ জলটা সমস্ত দিনে ৩ থেকে ৪ বার দাগগুলিতে লাগিয়ে দিতে হবে। তবে ২ থেকে ৪ দিন খেয়ে বা লাগালে সেরে যাবে। যদি না সারে তাহলে এটা ছেড়ে দিলে চলবে না; কমপক্ষে ৩ মাস ব্যবহার করতে হবে। তবে এটা ঠিক, যে দাগ সাদা দুধের মতো হয়ে গিয়েছে আর ৩ বৎসর হয়ে গিয়েছে, সেটা সেরে যাওয়া অর্থাৎ দাগ মিলিয়ে যাওয়া নিতান্তই দুরূহ ব্যাপার।

আরও পড়ুনঃ   বিরক্তিকর নাক ডাকা বন্ধের সবচাইতে সহজ ৬ টি উপায়

৬. শিশুদের দুধে শ্বাসে: অশ্বগন্ধা মূলের ক্বাথ করে, তেল মিশিয়ে বুকে পিঠে মালিশ করলে ওটা সেরে যাবে। মাত্রা নিতে হবে ৫ গ্রাম অশ্বগন্ধা মূল একটু থেঁতো করে এক কাপ জলে সিদ্ধ করে, ৩ থেকে ৪ চামচ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ঐ ক্বাথটা ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম সরষের তেলের সঙ্গে মিশাতে হবে।

অশ্বগন্ধার রাসায়নিক উপাদান: (a) Alkaloids. (b) Withanoliide, (c) Terpenoids.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১৬২-১৬৬।

আরও পড়ুনঃ নিয়মিত অশ্বগন্ধা খাওয়া উচিত কেন জানেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × 3 =