বিবাহ বিচ্ছেদ-শেষ অংশ

0
614
বিবাহ বিচ্ছেদ

পূর্বপ্রকাশিতের পর

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের তথ্য

মহিলা অধিদফতরের নারী নির্যাতন সেলের ছয়টি বিভাগীয় শহরের প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ২১ হাজার ১৪২টি মামলা বিচারাধীন আছে। মার্চ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ১৮হাজার ৩৬৭টি। মার্চ মাসে নতুন মামলা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩৪টি। এই সেলের বিচারে গত তিন মাসে বিবাদীর কাছ থেকে ভরণ-পোষণ ও সন্তানের ভরণ-পোষণ বাবদ আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫০ টাকা এবং প্রকল্পের শুরু থেকে এ যাবৎ মোট ২ কোটি ৬০ লাখ ৩৮ হাজার ৩৮২ টাকা আদায় করে বাদীকে প্রদান করা হয়েছে।

কাজী অফিসের তথ্য

মগবাজার ও লালমাটিয়া কাজী অফিস থেকে জানা যায়, এ বছর তালাক ও বিচ্ছেদের প্রবণতা বেশি। গত বছর যেখানে শতকরা ৫ থেকে ৩টি তালাক হতো, এ বছর সেখানে হয়েছে ৭ থেকে ১১টি। গেল বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দুই কাজী অফিসে বিয়ে হয়েছে ২৪৭টি। এর মধ্যে তালাক হয়েছে ২৩টি। বিচ্ছেদ ঘটেছে ৮টি। ১৪টি তালাক হয়েছে মেয়ের পক্ষ থেকে। বাকি ৯টি ছেলের পক্ষ থেকে। বিচ্ছেদের ঘটনার ৫টি মেয়ে পক্ষ থেকে এবং ৩টি ছেলে পক্ষের। মেয়ে পক্ষের প্রত্যেকেরই অভিযোগ ছিল, স্বামী ভরণ-পোষণ দেয় না। বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে জানা গেছে, দু’জনের মধ্যে সমঝোতা নেই। দম্পতিদের বিয়ের মোহরাণা ছিল সর্বোচ্চ ৫ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।

তালাকের জন্য নির্যাতন

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা চলে লোকচক্ষুর আড়ালে, ঘরের চার দেয়ালের ভেতর। এর জন্য স্বামী ও তার পরিবারই দায়ী থাকে। ইউনিসেফ জানায়, এ সমাজে ৪৭% নারী তার স্বামী ও পরিবারের অন্যদের হাতে নির্যাতিত হয়। গত জুন মাসে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতনের ৭৫ থেকে ৮৪ ভাগই ঘটে স্বামীর মাধ্যমে। গবেষণা করেছেন আইসিডিডি আরবির গবেষক রুচিরা তাব্যসসুম নভেদ। তিনি ঢাকা ও মতলব উপজেলায় এ গবেষণাটি চালান। এর মধ্যে ঢাকাতেই প্রায় ৪০ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার। স্বামীর পর নির্যাতনকারীদের মধ্যে রয়েছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ২০০৪-এর ১৪ জুন প্রেস ক্লাবে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে জুরাইনের পারভীন আক্তার। কাঁদতে কাঁদতে সে জানায়, বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়িতে উঠতে পারে না। তারপরও তার বাড়িতে এসেই তার দুই ভাসুর মেরে তার হাত ভেঙে দিয়েছে। আর এই বলে শাসিয়ে গেছে, ‘আমার ভাইকে তালাক দে, নইলে তোর মুখ এসিড দিয়ে ঝলসে দেবো।’ পারভীন ওই বছরের ৫ মে শ্যামপুর থানায় জিডি করে। তারপরও স্বামীর বাড়িতে অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকতে পারেনি সে।

বিচ্ছেদের প্রধান কারণ যৌতুক

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বিবাহিত জীবনের মতো নাজুক সম্পর্ক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হয়তো একটি কারণই যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বিভিন্ন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ ত্রিশূলের মতো দু’জনের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এসব কারণের মধ্যে এদেশে যৌতুক, পরকীয়া, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনই প্রধান। ১৯৮০ সালের সামাজিক অপরাধ হলেও গ্রামে, শহরে, উচ্চ, মধ্য ও নি¤œবিত্ত-সব পরিবারেই যৌতুক বিয়ের প্রধান মাফকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুক প্রতিরোধে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেছেন। যৌতুক বন্ধের আহ্বান জানিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে ১ লাখ ১২ হাজার টিঠি পাঠিয়েছেন। এদিকে ইউনিসেফ জানায়, গত ১০ বছরে বিয়ে হয়েছে এমন মেয়েদের শতকরা ৫০ ভাগ যৌতুকের শিকার। যৌতুক ছাড়া এখন বিয়ে হয় না। বিয়ে হলেও যৌতুক না দিয়ে বিয়ে টেকে না। চট্টগ্রামের হাটবাজারী উপজেলার ফতেহপুরের কবির উদ্দিনের মেয়ে শাহনাজের বিয়ে হয় ফতোয়াবাদের মুজাহিদুল আলমের সাথে। বিয়ের সময় মুজাহিদুল নিজেকে কোরিয়ার সিউল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ও জাপান থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস বলে দাবি করে। ভাল পাত্র পাওয়ায় শাহনাজের বাবা-মা ২ থেকে ৩ লাখ টাকার যৌতুক দেয়। কিন্তু মুজাহিদুদের সাধ মেটে না। সে আরো ৫ লাখ টাকা তৌতুকের জন্য শাহনাজের ওপর নির্যাতন চালায়। টাকা না পাওয়ায় মুজাহিদ চেকআপের নামে শাহনাজের গর্ভপাত করায়। এমনকি শাহনাজকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ব্যর্থ হয়ে মুজাহিদ গত বছরের ২৫ মে শাহনাজকে তালাক দেয়। তবে সাধারণ মানুষ যৌতুক পছন্দ করে না। দেশের প্রায় শতকরা ৯১ ভাগ জনগণ যৌতুক বিরোধী। ২০০৪-এর মে মাসে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সংবাদদাতারা দেশব্যাপী এক জরিপ চালান। ২ হাজার অংশগ্রহণকারী যৌতুকবিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি যৌতুক গ্রহণকারীকে বয়কটের অভিমত প্রকাশ করেছেন। এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, গত বছর প্রথম তিন মাসে যৌতুকের জন্য ৬৭টি মামলা পরিচালনা করে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা জানায়, গত বছর প্রথমে তিন মাসে যৌতুকের জন্য ১২ জন নারী নির্যাতিত হয়। ২০০৩ সালে যৌতুকের কারণে হত্যা কর াহয় ১২ জন নারীকে।  এদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছর। যৌতুকের পরেই রয়েছে পরকীয়া প্রেমের জটিলতা। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েরই পাল্লা-ভারী। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে পরকীয়ার কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা আমরা জানতে পারি। তবে পরকীয়ার কারণে বিচ্ছেদের ঘটনা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। গ্রামে পুরুষরা নারীদের প্রতি পরকীয়ায় এগিয়ে থাকলেও ঢাকা শহরে নারীরাই পুরুষদের প্রতি পরকীয়ায় রয়েছে এগিয়ে। বিদেশে অবস্থানরত অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীকে দীর্ঘদিন দেশে রেখে যাওয়ায় স্ত্রীরা জৈবিক খোরাক নিবারণের জন্য পুরুষ বন্ধু বেছে নিচ্ছে বলে মনোজগৎ ম্যাগাজিনের একটি পরিসংখ্যান তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তথ্যে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের শতকরা ৪৩ ভাগ বিবাহিত নারী পরকীয়া প্রেম করেন। তাদের স্বামীরা চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কাজের জন্য গড়ে বছরের ১০ থেকে ১১ মাস ঘরের বাইরে থাকেন।

আরও পড়ুনঃ   দাম্পত্য জীবন সুখী করার কিছু গোপন রহস্য!

ঋণ ও বীমার নামে তালাক

মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এলিনা খান পারিবারিক জীবনে সুখী হওয়ার কারণকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেন, বহুবিবাহ রোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রবর্তিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। বিশেষত নিম্ন মধ্য বিত্ত শ্রেণী এসব আইন সম্পর্কে অজ্ঞ। এই দুর্বলতাকে কব্জা করে চলে বিয়ের তালাকের নামে  প্রতারণা। বাস্তবেও দেখা যায়, অশিক্ষিত স্ত্রীকে ঋণ দেয়ার কথা বলে, বীমা করার লোক দেখিয়ে বা জমি দেয়ার কথা বলে একটি স্বাক্ষর বা টিপসই নিয়ে নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তা তালাক হিসেবে তুলে ধর াহয়। যশোরের কেশবপুরের পরসা গ্রামের দিনমজুরের মেয়ে নাজমা খাতুনের বিয়ে হলো বাঁশবাড়িয়া গ্রামের রকিব মৃধার সাথে। বিয়ের কয়েকমাস পরে রকিব মৃধা বাড়িতে নিয়ে আসে ব্রাকের দু’জন কর্মীকে। নাজমাকে বলে এক লাখ টাকা ঋণ নিতে হবে স্বাক্ষর দাও। পরে নাজমা বাবার বাড়ি গেলে নাজমার নামে ডাকে একটি খাম আসে। নাজমা খাম খুলে দেখে সই করা সেই কাগজ। তাতে লেখা স্বামীকে ডিভোর্স করা এফিডেফিট।

তালাক পেয়ে আত্মহত্যা

আমাদের দেশে মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষের চেয়ে ৭৫% বেশি। উচ্চবিত্ত মেয়েদের অবস্থান শতকরা ১৫% ভাগ, মধ্যবিত্ত, নিম্ন বিত্ত ও অতি দরিদ্রের মধ্যে এই হার ৮৫%। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, ’৯৯ সালে ৪৮ জন স্বামী পরিত্যাক্ত নারী আত্মহত্যা করে। শতকরা ৬৩ দশমিক ৪০ ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে দাম্পত্য কলহের কারণে। স্বামীর নির্যাতন ও কলহের কারণে আত্মহত্যা ঘটেছে ১১ দশমিক ৮০ ভাগ। ঝিনাইদহের  ‘আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণামূলক বই ‘আত্মহতার আর্থ-সামাজিক ও মনস্ত তাত্ত্বিক কারণ’  এ বলা হয়েছে- যৌতুক প্রথার জন্য ৯.৮৭%, পারিবারিক সমস্যা ও অশান্তির জন্য ২৫.৯২% এবং বহু বিবাহের জন্য ৬.৭৯% আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।

দেনমোহর সম্পর্কে মন্তব্য

তালাকে দেনমোহর পেয়েছেন কি-না কিংবা পূরণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে কেন করেছেন বা প্রথম স্ত্রীকে খোরপোষ দিয়েছেন কি-না এ প্রশ্নের উত্তর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছ থেকে নেতিবাচক ও মারমুখী ব্যবহারই আমরা পেয়েছি। যে দু’একজন একেবারে ঠা-ামাথায় উত্তর দিয়েছেন তাদের একজন নৃত্যুশিল্পী শামিম আরা নিপা। নিপা জানান, তালাক নারীর প্রতি সহিংসতারই অন্যরূপ। ঘরে ঘরেই নারী সহিংসতা বাড়ছে। সমাজের অন্য ক্ষেত্রেও অপরাধ তো কমছে না। আর সমাজের প্রতি কমিটমেন্ট রয়েছে বলেই নৃত্যের মাধ্যমেও তিনি সামাজিক অন্যাচারের অবসানের আহ্বান জানান। তিনি এ লক্ষ্যেই ‘সন্ত্রাস নয় শান্তি’ নামে একটি নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেন প্রায়শই। তালাকের সঙ্গে তিনি বলেন, সমঝোতা না হলেই তো মানুষ বিচ্ছেদ ঘটায়। যে সংসার থেকে সরে আসে সে টাকা পয়সার কথা চিন্তা করে না। তিনি নিজেও তার স্বামী হাসান ইমামের সাথে কোনও আইনি লড়াইয়ে যাননি। লাখ টাকার উপরে কাবিন হলেও তিনি একটি পয়সাও দাবি করেননি। চলচ্চিত্র অভিনেত্রী দিতি দু’দুটো বিয়ে করেছেন। দুটোই ভেঙে গেছে। তবে একটি বিয়ে বিচ্ছেদও মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি। দুটো বিচ্ছেদই নিজে ঘটিয়েছেন। প্রথম স্বামী সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে বিচ্ছেদে তার অভিযোগ ছিল পরনারী আসক্তির। সোহেল তার সামনেই অন্য নারী নিয়ে বেলেল্লাপনা করতো। তাই তাকে তিনি তালাক দেন। দ্বিতীয় স্বামী ইলিয়াস কাঞ্চলের সাতে বিরোধ বাঁধে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে। বিয়ের আগে দিতি ১৫ লাখ টাকা নেন কাঞ্চনের কাছ থেকে বাড়ি তৈরির জন্য। বিয়ের পর পরই কাঞ্চন সেই টাকার জন্য অপবাদ দেন। দিতি স্বামীর কাছ থেকে এ ধরনের অমানবিক ব্যবহার পেয়ে কাঞ্চনকে তালাক দেন ও ১০ লাখ টাকা ফেরত দেন। ৫ লাখ টাকা বিয়ের দেনমোহর হিসেবে কেটে রাখা হয়। নিপার্ট ভদ্রলোকের মতোই দেনমোহরের টাকা শোধ করেছেন জনপ্রিয় ব্যান্ড গায়ক জেমস।

আরও পড়ুনঃ   যে ৭ টি খাবার পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোনকে প্রাকৃতিকভাবে বৃদ্ধি করবে

৯১ সালে জেমসের সাথে পরিচয় হয় তার প্রথম স্ত্রী রথীর। রথী তখন আনন্দ বিচিত্রার ফটো সুন্দরী। ঐ বছরের অক্টোবরে তাদের বিয়ে হয়। দু’বছর পর জন্ম হয় পুত্র দানিশ। আরও দু’বছর পরে জন্মায় সুকন্যা নামের কন্যাসন্তানটি। এরই মধ্যে শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। ২০০০ সালে জেমসের সংসার ছেড়ে বাবার বাড়ি এসে ওঠেন। এ বছরই জেমস চলে যান আমেরিকায়। সেখান থেকেই টেলিফোনে রথীকে ডিভোর্স দেয়ার কথা জানান। ১ আগস্ট তিনি গীতিকার শিশু শিকদারকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নী দিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠান। রথী সই করেননি। তিনি তখনই সই করেন, যখন তাকে বিয়ের দেনমোহরের চার লাখ টাকা এবং দুই সন্তানের ভরণ-পোষণ বাদদ আরও ১৩ লাখ টাকা দেয়া হয়। এভাবেই অবসান ঘটে তাদের ১১ বছরের দাম্পত্য জীবনের।

বিচ্ছেদের কবলে শিল্পী-সাহিত্যিক

অনেক শিল্পী সাহিত্যিকরা বিচ্ছেদের কবলে পড়ে খুব দ্রুতই মানুষের মাঝে আলোচনায় চলে আসেন। অনেকে হয়ে ওঠেন অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত। এরমধ্যে আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে হয়েছেন প্রখ্যাত উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ। ২৮ বছরের বিবাহিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তার জনপ্রিয়তায় কিছুট হলেও ধস নামিয়েছেন। তবে তিনি তার প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনকে কোনওরকম অসম্মান করেনি। অনেক শিল্পী সাহিত্যিকরা বিচ্ছেদের কবলে পড়ে খুব দ্রুতই মানুষের মাঝে আলোচনায় চলে আসেন। অনেকে হয়ে ওঠেন অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত । শুধু শাওনকে ভালবেসে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন বলে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্বটা এমনেিতই তৈরি হয়ে গেছে। শুধু তিনি নন, বিয়ে বিচ্ছেদের তালিকায় আরও অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক রয়েছেন। তারা হলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক সানজিদা খাতুন, তাসলিমা নাসরিন, কবি রফিক আজাদ, নির্মলেন্দ গুন, সাযযাদ কাদির, অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, নায়িকা ববিতা, রোজী আফসারী, সুচরিতা, তারানা হালিম, শমী কায়সার, তানিয়া আহমেদ, রোজী সিদ্দিকী, তারিন, অভিনেতা সোহেল আরমান, আফসানা মিমি, তমালিকা কর্মকার, নৃত্যুশিল্পী শামিম আরা নিপা, অভিনেতা শাকিল খান, আলমগীর, অভিনেত্রী পপি, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, ডলি সায়ন্তনী, রবি চৌধুরী, সামিনা চৌধুরী, গায়িকা রিজিয়া পারভীন ও গীতিকার আব্দুল খালেক প্রমুখ।

আরও পড়ুনঃ   সুখী দাম্পত্য জীবন গড়তে স্বামী-স্ত্রীর করণীয়

এদেশের আলোচিত মামলা

১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে হেফজুর রহমানের সাথে শামসুন্নাহার বেগমের বিয়ে হয়। বিয়ের দু’বছর পর ১৫-১২-৮৭ তারিখে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয় এবং ৮৮ সালের আগস্ট মাসে হেফজুর রহমান শামসুন্নাহারকে তালাক দেয়। পরে শামসুন্নাহার নিজের ও তার নাবালক সন্তানের পক্ষে ভরণ-পোষণ চেয়ে মামলা দায়ের করেন দাউদকান্দি আদালতে। দাউদকান্দি আদালত সেখানে শামসুন্নাহারকে ৩ মাস ইদ্দৎকালীন ভরণ-পোষণ ও মোহরানা ইত্যাদি মিলিয়ে ৮৯ হাজার টাকা দেয়ার পক্ষে রায় দিলে হেফজুর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন কুমিল্লা জেলা জজ আদালতে। তার আপিলে অন্যান্য কারণের মধ্যে তিনি উল্লেখ করেন, সন্তানের জন্য মাসিক ১ হাজার টাকা করে দেয়াটা তার জন্য চাপ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় জেলা জজ তার রায়ে হেফজুর রহমানের জন্য সন্তানের মাসিক ভরণ-পোষণ ১ হাজার টাকা দেয়ার পরিবর্তে ৬০০ টাকা নির্ধারণ করেন। এই সাথে ৮৯ হাজার টাকা কমিয়ে ৭২ হাজার টাকা দেয়ার রায় দেন। হেফজুর আবারও সেই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করেন।

হাইকোর্ট কুমিল্লা জেলা জজ আদালতের রায় বাতিল করে দিয়ে পরে এ রায় দেন যে, বাদী ইদ্দৎকালীন সময়ে তো ভরণ-পোষণের টাকা পাবেই বরং তার দ্বিতীয় বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সে ভরণ-পোষণ পাবে। আমাদের দেশে হাইকোর্টে এ ধরনের রায় এটাই প্রথম। অসহায় নারীর অসহায়ত্বের সব দিক বিবেচনা করে তার স্বার্থ দেখেই দেয়া হয়েছে এ রায়। অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের প্রদত্ত রায়টি খারিজ করে দেয়।

পশ্চিমবাংলার আলোচিত মামলা

কলকাতার নারকেলডাঙ্গার এক বস্তিতে থাকেন শাকিলা পারভীন। স্বামী হায়দার আলী ১৯৯১ সালে শাকিলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। অসহায় শাকিলা শিয়ালদা কোর্ট খোরপোষের জন্য আইনি আবেদন করেন। ইতোমধ্যে স্বামী হায়দার আদালতে জানান, তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। সেইমতো দেনমোহররের টাকাও মিটিয়ে দিয়েছেন। ফলে শিয়ালদা কোর্ট শাকিলার আবেদন বাতিল করেন। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট তার আবেদন গ্রহণ করে। অবশেষে ২০০১ সালের জুন মাসে রায় দেয়, তালাকের পর যতদিন না দ্বিতীয় বিয়ে করছেন বা ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত শাকিলাকে তার স্বামী খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকবেন। হাইকোর্টের নির্দেশে, শাকিলা মাসে ৮০০ টাকা খোরপোষ পাবেন। এর আগে ১৯৮৫ সালে মোহররানা মামলার রায়ও তার পক্ষে যায়।

বিচ্ছেদ এক সামাজিক সমস্যা

বিচ্ছেদ যদিও প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, কিন্তু তারপরেও বিচ্ছেদ কোনও স্বামী-স্ত্রীর কাম্য নয়। কেউই বিচ্ছেদকে সহজে মেনে নিতে পারে না। বিয়ের পর দু’টি জীবনের মধ্যে যে গোপন ও মধুর সম্পর্ক তেরি হয়, গড়ে ওঠে গভীর শারীরিক-মানসিক সেতুবন্ধন, সেই বন্ধনকে অটুট রাখাই পূণ্যের কাজ। বিচ্ছেদ বা তালাকের কারণে স্বামী-স্ত্রীর বিচরণ ক্ষেত্র হয় কোর্টের বারান্দা। আদতে কোর্টের বারান্দা বা চৌকাঠ কখনও স্বামী-স্ত্রীর চলার রাস্তা হওয়া উচিত নয়, তাদের বিচরণ হবে শুধুই নিজের ঘরে। যে বাসর ঘর থেকে রচিত হয় স্বপ্নের  সোনালি সংসার আগামী দিনগুলো। সেই আনন্দঘন দিনগুলো যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একই ছাদের তলায় কাটে স্বামী-স্ত্রীর এটাই হলো সফল দাম্পত্য জীবন। সে জীবনে আইনরে কাঠগড়ায় নয়, যত ঝগড়া-বিবাদের মিল-মীমাংসা হবে শুধুই দু’জনের সমঝোতায়। এটাই হলো সংসারের প্রকৃত সুখ। বিচ্ছেদ কখনও শান্তি আনতে পারে না, বরং মানুষের মনস্তÍত্ত্বে সৃষ্টি করে অনাকাক্সিক্ষত ক্ষত। যে ক্ষত সমাজকেও ধীরে ধীরে পচাতে থাকে। তাই শান্তিকামী মানুষের একমাত্র করণীয় বিয়ের আগে দেখে-শুনে মনের মতো সঙ্গী খুঁজে নেয়া। বিয়ের পর বিচ্ছেদ ঘটানোর নিয়ম প্রচলিত থাকলেও এটা সামাজিক ব্যাধি। [সমাপ্ত]

আখতার হামিদ খান

বিঃ দ্রঃ গুরুত্বপূর্ণ হেলথ নিউজ ,টিপস ,তথ্য এবং মজার মজার রেসিপি নিয়মিত আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে লাইক দিন আমাদের ফ্যান পেজ বিডি হেলথ নিউজ এ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × three =