পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষায় নিম

0
1200
নিমের উপকারিতা

মানবজাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হলো সুস্থ জনগোষ্ঠী। আর এই সুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রথম প্রয়োজন নির্ভেজাল খাদ্য, নীরোগ স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু এসব যেন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে, দিন দিন খাদ্যে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। স্বাস্থ্যরক্ষার ওষুধ তাও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন পাওয়া দুষ্কর। পাশাপাশি অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে পরিবেশ দিন দিন হারাচ্ছে তার ভারসাম্য। গাড়ি, কলকারখানার কালো ধোঁয়া প্রতিনিয়ত দূষিত করছে বাতাস। ফলে পরিবেশ হয়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর, নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা।
এই ভেজাল থেকে মুক্তি পেতে এবং নীরোগ স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার ভেষজ চিকিৎসা ও উদ্ভিদের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মানুষ পশুপাখির নানা রোগ নিরাময় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিম অধিক ভূমিকা রাখে।

নিমের গুণ : নিমের বহুবিধ গুণের কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। নিম একটি অভূতপূর্ব গাছ, প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জন্য এত উপকারী গাছ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়নি। নিমের এই গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছে। ক্রিস্টের জন্মের ৫০০০ বছর পূর্বে থেকেই ভারত উপমহাদেশে নিমের অস্তিত্ব ছিলো বলে ধারণা করা যায়। প্রাচীনকাল থেকেই নিমের গুণাগুণ সম্পর্কে মানুষের ধারণা থাকলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয় আরো অনেক পরে। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু করে ১৯৭২ সনে। নিম নিয়ে বর্তমানে সর্বাধিক গবেষণা চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর জার্মানি, ভারত, কেনিয়া, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে (বিশেষ করে গত দুই তিন দশকে) নিম নিয়ে বিজ্ঞানীরা যেসব গবেষণা করছেন তাতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর পথ আরো সুগম হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে নিমের এই যে এতো কদর তা কিন্তু এর অ্যান্টিসেপটিক গুণটিকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল। নিম মধ্যস্থ বিভিন্ন যৌগগুলো অনেক ধরনের চর্মরোগ, সেপটিক সোর (স্পেশাল সোর) এবং সংক্রামক পোড়া ক্ষতের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। ফোঁড়া, আলসার ও অ্যাকজিমার চিকিৎসায় পাতার কাথ (ডিক্রেয়শন) অত্যন্ত ভালো কাজ দেয়। নিমের তেল গন্ডমালা  (রোগ) ইনডুলেন্ট আলসার এবং দাদ-এর মতো চর্মরোগ সারাতে ব্যবহার করা হয়। নিম এমনই একটি গাছ, যার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিমকে বলা হয় “প্রকৃতির দাওয়াখানা”। যার দ্বারা ফসলের কীটপতঙ্গ এবং প্রাণিকুলের রোগ দমন করা সম্ভব, দেশের আবাদি জমি ছাড়াই বসতবাড়ির চারপাশে, রাস্তার দুই পাশে, বাঁধের ধারে, রেললাইনের দুধারে নিমগাছ চাষ করে উক্ত গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে যেমন নানা কীটনাশক তৈরি সম্ভব তেমনি মানুষ পশু-পাখিসহ অন্যান্য যে কোনো প্রাণীর স্বাস্থ্য রক্ষায় এসব নিমগাছ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রাচীনকাল থেকেই প্রবাদ আছে, নিমগাছের বাতাস স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অনেক উপকারী।

আরও পড়ুনঃ   আঙুর খাওয়ার উপকারীতা

নিমের কিছু উপকারী দিক
ম্যালেরিয়া নিরাময়ে নিম : শতবর্ষ ধরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় নিম ব্যবহার করে আসছেন। ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে নিমের কার্যকারিতার কথা বহু পুরানো আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। এর মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে চরক লিখিত শাস্ত্রগুলো উল্লেখযোগ্য। নাইজেরিয়া ও হাইতিতে ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় নিম পাতার চা পানের রেওয়াজ আছে। সাম্প্রতিকালে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখছেন, নিমের পাতা ও বীজের নির্যাস ম্যালেরিয়ার ওপাটোজোয়া প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামকে ধ্বংস করতে সক্ষম। আর এ জন্য নিমের যে যৌগটি বেশি ভূমিকা রাখে সেটি হচ্ছে ‘জেডুনিম’। এটি এক ধরনের লিমোনোইড যৌগ যা ম্যালেরিয়া আক্রান্ত কোষ কালচারে কুইনাইনের মতই কাজ করে। নাইজেরিয়ার স্বল্প সমর্থিত একটি তথ্য অনুযায়ী নিম পাতার চা বহুদিন ধরে পান করলে যকৃতের ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
দন্ত চিকিৎসায় নিম : বাংলাদেশ ও ভারতসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বহুদেশে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন দাঁত মেসওয়াক করার জন্য নিমগাছের ডাল ব্যবহার করে। দন্ত চিকিৎসকরা ইতিমধ্যেই এই প্রাচীন প্রথাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কারণ, তারা দেখছেন, নিম “পেরিওডেন্টাল” রোগ নিবারণে অত্যন্ত কার্যকর। জার্মানীর একটি কোম্পানি বর্তমানে তাদের নির্মিত টুথপেস্ট এবং ওরাল হাইজিন প্রিপারেশনে সক্রিয় উপাদান হিসেবে নিমগাছের বাকলের নির্যাস ব্যবহার করছে, নিম ছালের নির্যাস মাড়ির প্রদাহ নিরাময় ও নিবারণে অত্যন্ত কার্যকর।

জন্মনিয়ন্ত্রণে নিম : গবেষণায় দেখা গেছে, নিম তেল একটি শক্তিশালী শুক্রাণুনাশক হিসাবে কাজ করে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, নিম তেল মহিলাদের জন্য নতুন ধরনের কার্যকরী গর্ভনিরোধক হতে পারে, এটি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই শুক্রাণু মেরে ফেলতে সক্ষম। গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে এক মিলিঃ ইন্ট্রাভ্যাজাইনাল ডোজ হিসেবে নিম তেল ব্যবহার করে এর কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে, পভিফনা কলার ডিস্ট্রোপ্যাথলজি করে তাতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ভারতে “সেনসাল” নামে একটি নিম তেলের ফর্মুলেশন গর্ভনিরোধক হিসাবে বাজারে ছাড়া হয়েছে।
পরিবেশ রক্ষায় নিম : নিম পরিবেশ রক্ষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাতাস শোধন করে এবং বাতাসকে অনেক অনুজীব ও ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখে। নিম তার সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অন্যান্য উদ্ভিদের চেয়ে বেশি পরিমাণ অক্সিজেন নির্গত করে। নিমের মধ্যে অত্যন্ত উপকারী গুণাগুণ থাকার কারণে ভারত উপমহাদেশে মনোবাসনা পূরণের, প্রশংসিত এবং সৌভাগ্যশালী গাছ মনে করা হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিমের বাতাস শোধনের ক্ষমতা প্রমাণিত এবং যুগ যুগ ধরে এর সুনাম রয়েছে। অস্বাস্থ্যকর, বিষাক্ত ও ক্ষতিকর পরিবেশ শোধনেও নিমের জুড়ি নেই। গ্রীষ্মের প্রচ- গরমের সময়ও নিমগাছের নিচে তাপমাত্রা থাকে ১০ ডিগ্রি সেঃ-এর চাইতেও কম। একটি পূর্ণবয়স্ক নিমগাছ দশটি এয়ারকন্ডিশনার-এর চাইতেও কার্যকরীভাবে বাতাসকে শীতল করতে পারে। বাংলাদেশ থেকে শুভেচ্ছা হিসেবে সৌদি আরবে প্রেরিত ৫০,০০০ নিমের চারা আরাফাতের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিবছর হজের সময় প্রায় ২০ লক্ষ হজযাত্রীদের শীতল ছায়া প্রদান করা ছাড়াও ঐ অঞ্চলের আবহাওয়া, ঋতু, প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। প্রাচীনকাল থেকেই ভারত উপমহাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে আসছে যে, বাড়ির আঙিনায় নিমগাছ রোপণ করলে তা আশপাশের বাতাসকে জীবাণুমুক্ত রাখে এবং পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলেও অনেক বাড়ির দরজায় নিমের ডাল ঝুলিয়ে রাখা হয় ঘরকে বায়ুবাহিত রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করতে। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিতে নিমের ব্যবহার হয়ে আসছে নানাভাবে। গুদামে শস্য সংরক্ষণে নিমের শুকনো পাতার ব্যবহার গ্রামবাংলায় প্রচলিত অনাদিকাল থেকে, নিম পাতার নির্যাস কীটনাশক হিসেবে জমিতে ব্যবহার করা হয়। তবে সুখের কথা হলো এটি কোন উপকারী পোশাকে ধ্বংস করে না। তাছাড়া এই কীটনাশক ফসলে ব্যবহার করলে বিষমুক্ত নিরাপদও এর গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে, নিমের পরিপক্ব বীজের শাঁস থেকে তেল বের করে নেয়ার পর যে খৈল পাওয়া যায় তা জৈব সার হিসেবে উত্তম। অন্যান্য কম্পোস্ট সারের চেয়ে এই সারে সর্বাধিক নাইট্রোজেন ও ফসফরাস থাকে, যা মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করে ফসলের অধিক ফলন দেয়।

আরও পড়ুনঃ   জিরা পানি খান সুস্থ্য থাকুন

ডা. পিজুষ দাস

জেনে নিন কিছু ভেষজ উদ্ভিদের অসাধারণ গুনাগুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

eighteen + eleven =