একটি সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে দুশো’রও বেশি বিষাক্ত পদার্থ যা শরীরের জন্য একটি বোঝা৷ কিন্তু ধূমপান বন্ধ করার ঠিক পরপরই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কী ভাবে পরিবর্তন ঘটে, তারই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকছে এই পোস্টে৷
সেই শুরু থেকেই ডাক্তাররা বলে আসছেন ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি ধূমপানের প্যাকেটেও মার্ক করে কথাটি লেখা থাকে। কিন্তু তাই বলে তো ধূমপান ছাড়ছেন না! এবার অবশ্যই ছেড়ে দেবেন। কেননা, ছেড়ে দেওয়ার পর কিছু বছরের মধ্যে শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে আড়াই কোটি মানুষ ধূমপানে আসক্ত। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে তামাক সেবন কমছে, সেখানে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিবছর ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে তামাকসেবী বাড়ছে। ধূমপান বন্ধে চাই সঠিক সচেতনতা।
ধূমপানের ক্ষতিকারক দিকসমূহ :
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের ৪০ বছরের পর হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেশি থাকে। ধূমপানের কারণে হতে পারে সিওপিডি-এমফাইসেমা, ক্রোনিক ব্রঙ্কাইটিস। শ্বাসনালির ইনফেকশনও বাড়ায় ধূমপান। ধূমপায়ীদের যক্ষা হওয়ার আশঙ্কা থাকে দুই থেকে চারগুণ বেশি। প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয় এরা। এ ছাড়া ঘন ঘন ফুসফুসের ইনফেকশন হয়। তা ছাড়া ফুসফুসের ক্যানসারের শতকরা ৯০ ভাগ কারণ ধূমপান। এ কারণে হতে পারে মুখ, গলা, খাদ্যনালি, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, যকৃৎ, মূত্রথলি, বৃহদান্ত্র ও মলাশয়, স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসার।
ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পর আমাদের শরীরে কী পরিবর্তন হয়?
ধূমপান ত্যাগ করার পর প্রতিটা সময় অতিক্রম করার সাথে আপনি নিচের সুবিধাগুলো অর্জন করতে শুরু করবেন:
♦ ২০ মিনিট : রক্তচাপ স্বাভাবিকে আসবে, নাড়ির স্পন্দন স্বাভাবিক গতিতে চলে আসবে, শরীরের তাপমাত্রা কমে স্বাভাবিক হবে৷ হাত ও পায়ে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে।
♦ ৮ ঘণ্টা : শেষ সিগারেট খাওয়ার ৮ ঘণ্টার মধ্যে আপনার শরীরে জমে থাকা কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায় ফুসফুস থেকে ক্ষতিকারক ও অস্বস্তিকর ব্যাকটেরিয়া দূর হবে।
♦ ১২ ঘণ্টা : সিগারেটের জ্বলন্ত আগুন থেকে বের হওয়া যে বিষাক্ত গ্যাস শরীর গ্রহণ করেছিলো, তা ১২ ঘণ্টা পর থেকে স্বাভাবিক হয়ে আসে৷ এবং শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়তে থাকে কারণ ধূমপান করার সময় রক্তে অক্সিজেন যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে৷
♦ ২৪ ঘণ্টা :চব্বিশ ঘণ্টা পর তাত্ক্ষণিকভাবে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি কমতে শুরু করবে।
♦ ৪৮ ঘণ্টা : ধূমপানের কারণে স্বাদ ও গন্ধ নেওয়ার যে ক্ষমতা কমে গিয়েছিলো, তা ধূমপান বন্ধ করার মাত্র দুইদিন পরেই বাড়তে শুরু করে৷ এই সময়ের মধ্যে ফুসফুসে জমে থাকা নিকোটিন শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে। ফলে ঘ্রাণ ও স্বাদ বোধ বাড়বে।
♦ ৩ দিন : ধূমপান থেকে বিরত থাকার তিনদিন পরে থেকেই বুকের ভেতরটা হালকা মনে হয় এবং শ্বাস ক্রিয়া সহজ হয়, কারণ তখন আর শরীরের ভেতরে নিকোটিন থাকেনা৷ আর সে কারণেই ধূমপান না করার লক্ষণগুলো ভালোভাবে ধরা পড়ে বা বোঝা যায়৷ তখন মাথাব্যথা, বমিভাব, প্রচণ্ড ক্ষুধা পাওয়া, হতাশা বা আতঙ্কভাব হয়ে থাকে৷ ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার ৩ দিনের মধ্যে আপনার ব্রঙ্কিয়াল টিউব প্রসারিত হবে। ফলে অনেক স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে পারবেন, এনার্জি ফিরে আসবে, স্ট্রেস কমবে।
♦ ২ সপ্তাহ থেকে ২ মাস : এই সময়ের মধ্যে শরীরে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হয়ে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা ৩০ শতাংশ বাড়ে। ফলে হাঁটাচলা করতে হাঁপিয়ে ওঠার সমস্যা কমে গিয়ে এনার্জি ফিরে পাবেন এবং কাশিভাবও কমতে শুরু করে৷
♦ ৩ থেকে ৯ মাস : এই সময় থেকেই বুঝতে পারবেন আপনার আর নিঃশ্বাস নিতে বিশেষ কষ্ট হচ্ছে না। ধূমপানের কারণে যে খুকখুকে কাশি হতো তাও অনেক কমে এসেছে। এই সময় থেকে ব্রঙ্কিয়াল টিউবের ফাইবার আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে থাকে। যা ফুসফুস থেকে ব্যাকটেরিয়ার দূর করে পরিষ্কার রাখে। মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি কমে এসে প্রায় অধূমপায়ীদের মতো হয়ে যাবে।
♦ ১ বছর : খনো যারা ধূমপান করছেন তাদের তুলনায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে অর্ধেক হয়ে যাবে এবং সময়ের সাথে সে ঝুঁকি ক্রমেই কমবে।
♦ ৫ বছর : সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার ৫ বছরের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। কোনো দিন ধূমপান না করলেও যে ঝুঁকি থাকে, ৫ বছর পর ঝুঁকির পরিমাণ ঠিক ততটাই কমে আসে।
♦ ১০ বছর : ধূমপানের ফলে ফুসফুসের যে ক্ষতি হয়, ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পর ১০ বছর সময় লাগে ফুসফুস আগের অবস্থায় ফিরে আসতে।
♦ ১৫ বছর : ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার ১৫ বছর পর হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ততটা, যতটা এমন কারও যিনি কোনো দিন ধূমপান করেননি।
ধূমপান ছাড়লে লাভ অনেক
ধূমপান নিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডা যৌথভাবে একটি দীর্ঘ গবেষণা করেছে। ৭ বছরব্যাপী এই গবেষণা রিপোর্টে বিশেষজ্ঞগণ উল্লেখ করেছেন ধূমপানের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি এতটাই ব্যাপক যে, ধূমপানের ফলে অতিমূল্যবান জীবনের ১০টি বছর কেড়ে নেয়। অর্থাত্ বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ধূমপানে অন্তত ১০ বছর আয়ু কমে যায়। তবে বিশেষজ্ঞগণ একটি আশারবাণীও শুনিয়েছেন। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, যদি ৪০ বছর বয়সের আগে ধূমপান ছেড়ে দেয়া যায় তবে ধূমপায়ীর শারীরিক অবস্থা আগের মতোই ফিরে যেতে পারে। এব্যাপারে সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্স-এর প্রধান ড. প্রভাত ঝার অভিমত : ধূমপান ছেড়ে দিলে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে আগের মতো ফিটনেস ফিরে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, যদি কেউ ৩০ বছর বয়সের আগে ধূমপান ছেড়ে দেয় তাদের অবস্থা এতটাই স্বাভাবিক হয় যে, মনে হয় না তারা কখনো ধূমপায়ী ছিলেন। ধূমপান ছাড়ার উপকারিতা নিয়ে সবচেয়ে ভালো খবর দিয়েছেন টরেন্টোর সেন্ট জোসেফ হেলথ সেন্টারের রেসপাইরেটারী মেডিসিন বিভাগের প্রধান ড. গ্রাহাম বারলিন। তার অভিমত : যাদের ফুসফুসের কার্যক্রম কমে গেছে তারা যদি ধূমপান ছেড়ে দেন তবে ফুসফুস অধিকতর ক্ষতি হতে রক্ষা পায়। পাশাপাশি ফুসফুসের কার্যকারিতার ক্ষতি বা লাঙ্গ ক্যাপাসিটির যতখানি অবনতি ঘটে ধূমপান ছেড়ে দিলে তার আবার উন্নতি হতে শুরু করে। তাই যে কোনো বয়সে ধূমপান ছাড়লে অবশ্যই ফুসফুস, হার্ট, মস্তিষ্কের ক্ষতির ঝুঁকি হরাস পায় এমন অভিমত গবেষকদের।
-ডা. মোড়ল নজরুল ইসলাম