চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা কী? চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম? যে সব কারণে চিয়া সীড একটি সুপারফুড!

0
31720
চিয়া সিড এর উপকারিতা
চিয়া সিড এর উপকারিতা

চিয়া সীড মূলত সালভিয়া হিস্পানিকা বা চিয়া উদ্ভিদের অন্তর্ভুক্ত, যা পুদিনা পরিবারের একটি প্রজাতি। এই বীজটি, সেন্ট্রাল আমেরিকার অনেক অংশে পাওয়া যায়। সেন্ট্রাল আমেরিকার প্রাচীন অধিবাসীদের কাছে সোনার চেয়েও মূল্যবান ছিলো এই বীজ। তারা এই বীজকে নিজেদের সাহস ও শক্তি জোগানোর উৎস মনে করতো। তাই একে এক ধরণের ভেষজও বলা হয়। যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চিয়া স্বাভাবিকভাবেই শস্যের শ্রেণিতে পড়ে। চিয়া সীডের পুষ্টিগুণ অনেক। উদাহরণস্বরূপ, এক গ্লাস দুধের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম, বাদামের চেয়ে বেশি ওমেগা -3 এবং অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপস্থিত । যা ব্যক্তিকে প্রচুর পরিমাণে শক্তি সরবরাহ করে। চিয়া বীজ ওজন হ্রাস করার জন্য উপকারী কারণ এটির মধ্যে চর্বি শোষণ করার ক্ষমতা বেশি। যা ব্যক্তির শরীরে পানির অভাব পূরণে সহায়তা করে। সাইজে ছোট হলেও স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের তালিকায় প্রথম দিকের অবস্থান কিন্তু ঠিকই দখল করে আছে এই চিয়া সিড।

এই চিয়া বীজ দেখতে তিলের মতো, এরা সাদা ও কালো উভয় রঙের হয়। এই বীজের ভালো একটি গুণ হলো এরা সব ধরনের আবহাওয়ায় হয় এবং এদেরকে পোকামাকড় সহজে আক্রমণ করতে পারে না। অনেকেই একে ব্যাসিল সীড বা তোকমার সাথে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু চিয়া বীজ তোকমার চেয়ে আকারে ছোট।

চিয়া সীডের উপকারিতা

চিয়া সীডের অনেক পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে। এতে রয়েছে শর্করা, ফাইবার, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, দস্তা, তামা, পটাশিয়াম এবং চিয়া বীজ, প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড, আলফা-লিনোলেনিক এবং লিনোলিক অ্যাসিড, পাশাপাশি ভিটামিন এ , বি, ই, ডি এবং সালফার, আয়রন, আয়োডিন, ম্যাগনেসিয়াম, নিয়াসিন এবং থায়ামিন সহ খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির একটি প্রধান উৎস। যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

  • দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশী ক্যালসিয়াম
  • কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি
  • পালং শাকের চেয়ে ৩ গুণ বেশী আয়রন (লোহা)
  • কলার চেয়ে দ্বিগুণ পটাশিয়াম
  • স্যামন মাছের থেকে ৮ গুণ বেশী ওমেগা-৩

তাই চিয়া সীড একটি সুপার ফুড।

বিশেষজ্ঞদের মতে এক আউন্স (২৮ গ্রাম) চিয়া সিডে আছে;
ফাইবার- ১১ গ্রাম
প্রোটিন- ৪ গ্রাম
ফ্যাট- ৯ গ্রাম (যার ৫ গ্রাম আবার Omega-3s)
ক্যালসিয়াম- RDA (Recommended Dietary Allowance) এর ১৮%
ম্যাঙ্গানিজ- RDA এর ৩০%
ম্যাগনেসিয়াম- RDA এর ৩০%
ফসফরাস- RDA এর ২৭%
সমুচিত পরিমাণে জিঙ্ক, ভিটামিন বি৩ (নায়াসিন), পটাশিয়াম, ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) ও ভিটামিন বি২

আরও পড়ুনঃ   সরিষার তেল না খেয়ে যে উপকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন

এনার্জি – ১৩৭ ক্যালোরি,

কার্বোহাইড্রেড – ৩ গ্রাম

জিঙ্ক – ১ মিলিগ্রাম

তামা – ১ মিলিগ্রাম,

পটাশিয়াম – ৮ মিলিগ্রাম,

চিয়া সীডের উপকারিতা-যে ২০টি কারণে চিয়া সীড একটি সুপারফুড

১। চিয়া বীজ এ রয়েছে প্রচুর পরিমানে এন্টি অক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ কোষ ও ত্বকের রক্ষনাবেক্ষন করে থাকে। এন্টি অক্সিডেন্ট আপনার মুখে বয়সের ছাপ রোধ করবে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় এটাও প্রমাণিত যে এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার এর বিরুদ্ধে লড়াই করে। চুল ও ত্বক চকচকে ও প্রাণবন্ত রাখতেও এর জুড়ি নেই। তাই দেহে এন্টিঅক্সিডেন্ট এর ঘাটতি মেটাতে চিয়া বীজ হতে পারে খুব ভালো একটি সমাধান।

২। চিয়া সীড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে

৩। চিয়া সীড ওজন কমাতে সহায়তা করে। যদি কোনও ব্যক্তি ওজন হ্রাস করার চেষ্টা করে তবে তার জন্য চিয়া  সীড খুব উপকারী। এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। যা ফ্যাট কমাতে সহায়তা করে। শরীরের ওজন কমতে শুরু করে।

৪। চিয়া সীড ব্লাড সুগার (রক্তের চিনি) স্বাভাবিক রাখে, ফলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায়। অর্থাৎ চিয়াতে এমন অনেক পুষ্টি রয়েছে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে সহায়তা করে। যা ইনসুলিন তৈরিতে সহায়তা করে। শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৫। চিয়া সীড হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ উপকারি। হাড়কে শক্তিশালী করার জন্য ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। চিয়া বীজে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম এবং প্রোটিন থাকে। এগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়াম এর পরিমান চোখে পড়ার মতো। প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া বীজে প্রায় ৬৩১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে।যারা দুধ বা দুগ্ধ জাত খাবার খেতে পারেন না তাদের জন্য খুব ভালো একটি ক্যালসিয়াম এর উৎস চিয়া সীড, যা হাড়কে মজবুত করতে সহায়তা করে। হাড়কে শক্তিশালী করার কারণে হাড়ের সমস্যা হয় না।

৬। চিয়া সিড মলাশয় (colon) পরিষ্কার রাখে ফলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়

৭। চিয়া সিড শরীর থেকে টক্সিন (বিষাক্ত পদার্থ) বের করে দেয়

৮। চিয়া সীড প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করে

৯। চিয়া সীড পরিপূর্ণভাবে ঘুম হতে সাহায্য করে।

১০। চিয়া সীড ক্যান্সার রোধ করে

১১। চিয়া সিড হজমে সহায়তা করে, চিয়া সীড এ রয়েছে প্রচুর ফাইবার যা মলাশয় পরিষ্কার রাখে। নিয়মিত সেবনে এটি পেট পরিষ্কার রাখবে কোষ্টকাঠিন্য দূর হবে এবং হজম শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

আরও পড়ুনঃ   চীনা বাদাম এর উপকারিতা: চীনাবাদামের গুণাগুণ/ চীনা বাদামের পুষ্টিগুণ!

১২। চিয়া সীড হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা দূর করে

১৩। চিয়া সীড এটেনশান ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিসর্ডার (Attention deficit hyperactivity disorder ADHD) দূর করে

১৪। চিয়া সিড ত্বক, চুল ও নখ সুন্দর রাখে

১৫। চিয়া সীড গৃহপালিত পশুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়

১৬। চিয়া সীড এ যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে।ওজন অনুসারে প্রায় 14% প্রোটিন থাকে চিয়া বীজে যা বেশিরভাগ উদ্ভিদের তুলনায় অনেক বেশি। যারা ভেজিটেরিয়ান তাদের জন্য খুব ভালো একটি প্রোটিন এর উৎস এটি। এছাড়াও পরিপূরক খাদ্য হিসেবেও এটি প্রোটিন এর ঘাটতি মেটাতে পারবে।

১৭। এটা শক্তি এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে কারণ চিয়াতে প্রাকৃতিকভাবে অনেক খনিজ এবং ভিটামিন থাকে। যা শরীরে শক্তি জোগায়। শরীরে আরও বেশি কাজ করার ক্ষমতা থাকা শুরু করে।

১৮। চিয়া সীড এ খুব ভালো পরিমান ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড রয়েছেপরিমানে যা সামুদ্রিক মাছ স্যামন এর থেকেও বেশি।তবে চিয়া সীডস থেকে প্রাপ্ত ওমেগা-৩ অতটাও উন্নত নয় যতটা আসলে ভাবা হয় কারণ চিয়া বীজ ALA সরবরাহ করে যা দুর্ভাগ্যবশত মানবদেহ সক্রিয়রূপে রূপান্তর করতে অক্ষম।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওমেগা-৩ ফ্যাট হচ্ছে DHA যা চিয়া সীড সরবরাহ করতে পারে না।

১৯। চিয়া সীডে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, প্রোটিন এবং ওমেগা-৩ রয়েছে যা হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সক্ষম।ইঁদুরের উপর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে চিয়া সীড ট্রাইগ্লিসারাইড, প্রদাহ, ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং পেটের চর্বি সহ কিছু ঝুঁকির কারণগুলি হ্রাস করতে পারে এবং ভালো এইচডিএল কোলেস্টেরলও বাড়িয়ে তুলতে পারে।এছাড়াও কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে চিয়া বীজ উচ্চ রক্তচাপের মানুষের রক্তচাপকে
উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। তাই হার্ট এর সুস্থতায় চিয়া সীড হতে পারে আপনার নিত্যদিনের সঙ্গী।

২০। ব্লাড সুগার লেভেল নরমাল রাখে। ব্লাড প্রেসার ও কোলেস্ট্রল কমায়।

চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম:

স্থান ভেদে চিয়া বীজ খাবার নিয়ম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বিভিন্ন
ফলের রস এর সাথে বা পানিতে মিশিয়ে সাধারণত চিয়া সীড খাওয়া হয়ে থাকে। স্বাদ ও ঘ্রাণহীন হয়ে থাকে বলে
অনেক দেশে রুটি বা বিস্কুট এর সাথেও এটি সেবন করা হয়ে থাকে। তবে ১ গ্লাস পানি-তে ১ চা চামচ পরিমান
নিয়ে ভালো ভাবে মিশিয়ে আধা ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে খালি পেটে খেলে ভালো উপকার মেলে।

আরও পড়ুনঃ   গ্রিন টি কেন খাবেন ?

দ্রুত ওজন কমাতে খালি পেটে সকালে এবং রাতে ঘুমানোর আগে ১ গ্লাস পানির মধ্যে ২ চা চামচ চিয়া সিড ও ২ চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।খাওয়ার ৩০মিনিট আগে নরমাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে

সকালে খালি পেটে বা রাতে ঘুমানোর আগে হালকা কুসুম গরম পানিতে ২০-৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন ,তারপর ফিল্টার করে অথবা ফিল্টার করা ছাড়া পান করুন

চিয়া সীডের অপকারিতা:
চিয়া সীডের অনেকগুলি স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। তবে এর কোন অসুবিধা থাকলেও সেটা সম্পর্কে জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

– অতিরিক্ত পরিমাণ চিয়া সীড খাওয়ার কারণে ওজন অতিরিক্ত কমে যেতে পারে। এতে দেহে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই কোন কিছু অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয়।

– চিয়া বীজ ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর এ ব্যাপারে উপরে আলোচনা করা হয়েছে। তবে কিছু বিজ্ঞানী, চিয়া সীড সম্পর্কে বলেছেন যে তাদের দ্বারা পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এর বীজগুলি প্রোটেস্ট ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সারকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এটি চিরন্তন সত্য কোন কথা নয়, তাই এ ব্যাপারে আরো অনেক গবেষণা চলছে এখনো। সুতরাং এটি সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত।

– চিয়া সীড বেশি খাওয়ার ফলে পেটের সমস্যা হতে পারে। কারণ চিয়া সীডের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। তাই অল্প পরিমাণে চিয়া সেবন করুন। যদি চিয়া সীড গ্রহণ করে কোন ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে মনে হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এটি সেবন করা বন্ধ করুন।

– এটি শুকনো হওয়ায় সরাসরি খেলে অনেক সময় গলায় আটকে যেতে পারে। তাই চিয়া সীড খাওয়ার আগে কমপক্ষে ১০-১৫ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রাখা উচিৎ।

– আমরা জানি, চিয়া বীজ দেহের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে রক্তচাপ কমায়। তাই অতিরিক্ত পরিমাণ চিয়া বীজ সেবন করলে রক্তচাপ বেশি কমে যেতে পারে।

সমাপনীতে বলা যায়,
চিয়া সিড বা চিয়া বীজ হল সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবারের মধ্যে এবং সাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে একটি। শরির আর মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারি পুষ্টি দিয়ে ভর্তি চিয়া সিড।

আরও পড়ুনঃ
রোগমুক্ত থাকার উপায়: নিয়মিত খেতে হবে এই ১০টি খনিজ পুষ্টি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

8 − eight =