একজন ৬০ বছর বয়স্কা রোগী ডাক্তারের কাছে এসে বললেন ‘আমার ডান পায়ের হাঁটুতে ব্যথা, অন্য কোনো সমস্যা নেই, আমাকে বাতজ্বরের পরীক্ষা করে চিকিৎসা দিন’ জবাবে চিকিৎসক তাকে ব্যাখ্যা করে বললেন, এই জ্বর বাতজ্বর নয়। ভদ্রমহিলা বিশ্বাস করতে চান না, তাই আবার বললেন ‘আমার মেয়ের গিড়ায় ব্যথা সমস্ত শরীরে চলাচল করে তার বাতজ্বর তাহলে আমার ১টি গিড়ার ব্যথাও বাতজ্বর’। রোগীদের এমন স্বাস্থ্যজ্ঞান আগেও ছিল, এখনো আছে, হয়তো ভবিষ্যতে থাকবে না যদি বাতজ্বর সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্ঞান লাভের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের সহায়তা পান।
বাতজ্বর কি?
এন্টিজেন-এন্টিবডির বিক্রিয়ায় প্রদাহজনিত কারণে কানেকটিভ টিসুতে কিছু ক্ষতের সৃষ্টি হয় এই ক্ষত থেকেই হৃৎপিণ্ড স্থায়ীভাবে আক্রান্ত হতে পারে।
কাদের বেশি হয়?
সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছরের শিশু যারা স্বাস্থ্যহীনতা ও অপুষ্টিহীন স্যাঁতসেঁত জায়গায় বসবাস করে। ঘন ঘন টন্সিল ফুলে যাওয়াতে এই রোগরে সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মেয়েদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি। গরিব দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাতজ্বর বেশি হয়ে থাকে।
বাতজ্বর কিভাবে হয়?
গ্রুপ-এ স্ট্রেপটোকক্কাস বিটা হিমোলাইটিকাস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঊর্ধ্ব শ্বাসনালীতে সংক্রমণ হলে এই রোগের ধারাবাহিকতা শুরু হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এন্টিজেন-এন্টিবডি বিক্রিয়ায় হৃৎপিণ্ড ও জয়েন্টের টিসু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এই রোগ পরিপূর্ণরূপ গ্রহণ করে।
অসুবিধা ও চিহ্নসমূহ :
১. জয়েন্ট বা গিড়া ব্যথা-
জয়েন্ট বা গিড়ায় ব্যথা হয়। এই ব্যথা একাধিক গিড়ায় হয় এবং এক জয়েন্ট থেকে অন্য জয়েন্টে যায় যা গরমৎধঃরহম ঢ়ড়ষুধৎঃযৎরঃরং নামে পরিচিত। জয়েন্টে শুধু ব্যথা হতে পারে (অৎঃযৎধষমরধ) আবার জয়েন্টে ফুলে লাল ও গরম (অৎঃযৎরঃরং) হতে পারে। শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণের ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে সাধারণত গিড়ার সমস্যা প্রকাশিত হয়। একটি গিড়ায় এই প্রদাহ স্থায়ী হয় না। একটি ভালো হয়ে অন্যটি আক্রান্ত হয়।
২. কার্ডাইটিস বা হৃদযন্ত্রের প্রদাহ-
“জযবঁসধঃরপ ভবাবৎ ষরপশং ঃযব লড়রহঃ নঁঃ নরঃবং ঃযব যবধৎঃ”
হৃদযন্ত্রের প্রদাহের জন্য হৃদস্পন্দনের পরিমাণ বেশি হয় যা মিনিটে ১০০-এর চেয়ে বেশি থাকে। জ্বর না থেকেও হৃদস্পন্দন বেশি থাকে (টহফঁব ঃধপযুপধৎফরধ), কার্ডাইটিসের কারণে হার্টের ভালব (যবধৎঃ াধষাব) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভালব একটি উপাদান যার মধ্য দিয়ে রক্তের একমুখী স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত হয়। ঠধষাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সরু/চিকন হতে পারে বা ঠিকমতো বন্ধ না হয়ে বিপরীত দিকে অস্বাভাবিক রক্ত প্রবাহিত হতে পারে। ভালভ নষ্ট হয়ে পর্যায়ক্রমে দেহের অন্যান্য অংশকে কর্মহীন করতে পারে। মানব হৃৎপিণ্ডের প্রাকৃতিক ভালভ অমূল্য। এই স্বাভাবিক ভালভের বিকল্প কিছু হতে পারে না। পৃথিবীর সব সম্পদ ও অর্থ দিয়েও ১টি প্রাকৃতিক ভালব ক্রয়ের ক্ষমতা অর্জন করা যাবে না। তাই সর্বোচ্চ চেষ্টায় হৃৎপিণ্ডের ভালভ (ঘধঃঁৎধষ াধষঁব) রক্ষা করতে হবে।
৩. সিনডেম হাম কোরিয়া-
সিনডেমহাম কোরিয়া হাতের এক ধরনের অস্বাভাবিক নড়াচড়া যা নিয়ন্ত্রণহীন ও দৈনন্দিক কাজকর্মে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মাংসপেশির দুর্বলতা এবং আবেগজনিত সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা ঘুমের সময় হয় না।
৪. ইরাইথেমা মার্জিনেটাম ও নোডিওল-
চামড়ার বিশেষ ধরনের কুড়ি বা দানা দেখা যেতে পারে।
৫. জ্বর-
সাধারণত বেশি হয় না, জ্বর এই রোগের অপ্রধান উপসর্গ বা সমস্যা, জ্বর সাধারণ ৩৮.২ থেকে ৩৮.৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (বা ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট)-এর মধ্যে থাকে।
রোগ নির্ণয় :
রোগীর অসুবিধা ও লক্ষণ দেখে চিকিৎসক প্রযোজ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জোন্স চরিত্র চিত্রনের মাধ্যমে বাতজ্বর নির্ণয় করতে পারেন। সাধারণত যেসব পরীক্ষা প্রয়োজন হয়-
১. রক্ত-ইএসআর, টিসি, ডিসি, এএসও টাইটার, সিআরপি।
২. বুকের এক্স-রে
৩. ইসিজি
৪. ইকোকার্ডিওগ্রাফি।
রক্তের পাশাপাশি বুকের এক্স-রে, ইসিজি করা হয়। হৃৎপিণ্ডের গঠন, আকার-আকৃতি নির্ণয়, ভালভের অবস্থা ব্যাখ্যা করার জন্য ইকোকার্ডিওগ্রাফি খুবই দরকারি পরীক্ষা যা ভালভের সমস্যা নির্ণয়ের পাশাপাশি রোগের হ্রাস-বৃদ্ধির মাত্রা হিসাব করতে পারে। বাতজ্বরে ইকোকার্ডিগ্রাফির কোনো বিকল্প নেই।
এএসও টাইটার :
সাধারণ মানুষ বাত্বজ্বর নিয়ে যত চিন্তা করেন তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করেন অঝঙ ঃরঃৎব (ধহঃর-ংঃৎবঢ়ঃড়ষুংরহ ঙ) নিয়ে। স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের পর এএসও টাইটার বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র এ,এস,ও পরীক্ষা করেই বাতজ্বও নির্ণয় করা যায় না। রোগীর ইতিহাস বিশ্লেষণ, উপসর্গ পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের পাশাপাশি অঝঙ ঃরঃৎব-এর পরিমাণ বিবেচনা করেই বাতজ্বর নির্ণয় করা হয়। একটি কথা মনে রাখতে হবে, অঝঙ ঃরঃৎব বাতজ্বর নির্ণয়ে একটি সহায়ক পরীক্ষা মাত্র। শুধুমাত্র এএসও টাইটার বেশি হলেই বাতজ্বর বলা যাবে না, আবার স্বাভাবিক মাত্রায় পাওয়া গেলেই বাতজ্বর নেই এমনটি বলা যাবে না। বিষয় এতই সোজা নয়। বাতজ্বর ছাড়া যেসব কারণে অঝঙ ঃরঃৎব বেশি হতে পারে।
১. পোস্ট স্ট্রেটপট্রো গøুমেরুলো নেফরাইটিস
২. স্কারলেট ফিভার
৩. ইরাইসিপিলাস
৪. নিউমেনিয়া
৫. যেকোন স্ট্রেপটোকক্কাল ইনফেকশন
বাতজ্বর ও রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস-এর পার্থক্য :
বাতজ্বর থেকে যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে –
১. হৃৎপিণ্ডের ভালভ বন্ধ/কর্মহীন হয়ে যাওয়া
২. হার্ট ফেইলর হয়ে শ্বাসকষ্ট, শরীরে পানি জমে থাকা,
৩. হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন (অৎৎযুঃযসরধ)
৪. ইনফেকটিভ এন্ডোকারডাইটিস
৫. এম্বোলিজম
৬. পড়ালেখায় সাফল্যের কমতি
৭. দৈহিক কর্মহীনতা
৮. মানসিক অশান্তি
৯. অর্থনৈতিক সমস্যা
১০. সামাজিক সমস্যা।
চিকিৎসা :
চিকিৎসক নির্ধারিত ধারাবাহিক চিকিৎসা নিতে হবে। রোগ নির্ণয় থেকে পাঁচ বছর বা রোগীর বয়স ২১ বছর পর্যন্ত যেটি দীর্ঘস্থায়ী সেই সময় পর্যন্ত চিকিৎসা চালাতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আজীবন ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
প্রতিরোধ :
বাতজ্বরের জটিলতা পরিহার সাশ্রয়ী ও কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে এ রোগের প্রতিরোধ। চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ ঃৎবধঃসবহঃ. বাতজ্বরের প্রতিরোধে যা করণীয়-
১. স্যাঁতসেত জায়গায়/রুমে বসবাস করা যাবে না।
২. গাদাগাদি করে বসবাস করা যাবে না।
৩. নিয়মিত দাঁত ব্রাশ ও মুখের যতœ নিতে হবে।
৪. ঠাণ্ডা পানি পান করা যাবে না।
৫. ঠাণ্ডা খাবার, আইসক্রিম, ফ্রিজের ঠাণ্ড জিনিস খাওয়া যাবে না।
৬. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
৭. শ্বাসতন্ত্রের যে কোনো সংক্রমণে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
৮. শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে
৯. চিকিৎসার ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে।
১০. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
১১. শিশুদের আদর্শ জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
শেষকথা :
বাতজ্বর চিকিৎসার চেয়ে রোগ নির্ণয় কঠিন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক চিকিৎসকের মধ্যেও এই রোগ নির্ণয়ে ঐকমত্যের অভাব দেখা দিতে পারে যা সংশোধনযোগ্য। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কিংবা দক্ষ জেনারেল প্রাকটিশনারের (এচ) নির্দেশনায় বাতজ্বর নির্ধারণ ও প্রযোজ্য চিকিৎসা নিতে হবে। বাতজ্বরে ধারাবাহিক চিকিৎসার মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের ভালভ রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ও গঠনমুখী জীবন (চৎড়ফঁপঃরাব ষরভব) যাপন করা যায়।
হ ডা. লিয়াকত হোসেন তপন
হৃদরোগ ও বাতজ্বর বিশেষজ্ঞ এবং ফিজিসিয়ান
কনসালটেন্ট, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস লি:
উত্তরা শাখা, বাড়ি- ১১, সোনারগাঁও জনপথ,
সেক্টর-৭, উত্তরা।